সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে লালদীঘি পার্ক। তবে খাবার সামগ্রীর প্যাকেট নিয়ে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না। এছাড়া পার্কের ভেতর নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যত্রতত্রভাবে কোন বর্জ্য না ফেলা যাবে না। লালদীঘিকে না-চিনলে, না-জানলে চট্টগ্রামকে চেনা ও জানা যাবে না। লালদীঘি শুধু এক টুকরো নৈঃসর্গিক ভূমি নয়, স্মৃতি, সত্তা ও অস্তিত্বের শিকড়।
গতকাল শুক্রবার সকালে পার্কটি উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেছেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, বাহারী ফুল ও বৃক্ষরাজির সজীব সবুজে সাজানো হয়েছে পার্কে। দীঘির চারপাশ দিয়ে প্রাত: ও বৈকালিক ভ্রমণকারীদের স্বচ্ছন্দে হাঁটাহাটির জন্য ওয়াকওয়ে করে দিয়েছি। নানান উপাদানে পার্কটি নান্দনিক করা হয়েছে। এখন সকাল ৬ টা থেকে ৮ টা এবং বিকেল ৩ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। লালদীঘির চারপাশে মিউজিক্যাল লাইটিংয়ের মাধ্যমে আলো ও সুরের মুর্চ্ছনা ইভেন্ট যুক্ত করা হবে।
প্রশাসক আরো বলেন, লালদীঘিকে ঘিরেই চট্টগ্রামের ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানান বর্ণিল অধ্যায় সূচিত হয় এবং অনেক বীরত্বগাথার স্মৃতির হীরকখণ্ড এখনো ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে চোখের মণিতে জ্বলজ্বল করে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ নেয়া তরুণ ও যুবকদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে আজ থেকে শতবর্ষ আগে আবদুল জব্বার বলী খেলার সূচনা করেন। একে ঘিরেই প্রতি ১২ বৈশাখ লালদীঘির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেশের সর্ববৃহৎ বৈশাখী লোকখেলা হয়ে আসছে। এই লালদীঘির পূর্বে চট্টগ্রাম, জেল কারাগারে ব্রিটিশ রাজশক্তি অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিল। তারপরের ইতিহাস আরো গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রমনা ভাষা শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হবার পর দিন লালদীঘি ময়দানে একুশের প্রথম কবিতা মাহবুুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ পাঠ করেছিলেন চৌধুরী হারুনর রশীদ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই লালদীঘির মাঠে সর্বপ্রথম জনসভায় ৬ দফা ঘোষণা করেন। একাত্তরের অসহযোগের অগ্নিঝরা দিনে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটক এই লালদীঘি মাঠে মঞ্চস্থ হয়। মৌলভী ছৈয়দ আহমদ ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে জয়বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হয় এখানে। এটাই ছিলো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক মহড়া। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালদীঘি মাঠে জনসভা করতে আসার পথে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টায় সামরিক স্বৈরশাসকের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে লালদীঘির অনতিদূরে শহীদ ২৬ জন বাঙালি। এ ধরনের অনেক বীরত্বগাথার ইতিহাস আছে লালদীঘিকে ঘিরে। তাই চট্টগ্রামের ইতিহাস, রাজনীতি-ধর্ম-সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রে লালদীঘির সম্পৃক্ততা চিরকালীন ও সর্বজনীন তাই চট্টগ্রামকে চেনা ও জানার নাভিমূল এই লালদীঘি।
তিনি আরো বলেন, ১৯৩৯ সালে তৎকালীন কুলীন জমিদার নন্দন কাননের রাজ কুমার ঘোষ তাঁর নিজস্ব জায়গায় লালদীঘির গোড়াপত্তন করেন এবং লালদীঘির চারপাশে বাগান করেন। পরবর্তীতে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজ কুমার ঘোষের পরিবার থেকে প্রতীকী মূল্যে লালদীঘি চসিকের মালিকানাধীন করেন এবং দীঘি ও পার্কের নানন্দিক রূপ দেন। তখন এটা হয়ে ওঠে নগরবাসীর প্রাত: ও বৈকালিক ভ্রমণের একটি অতুলনীয় উপাদান। তবে পরে এটা ধীরে ধীরে নান্দনিকতা হারিয়ে ফেলে এবং অসামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য এর পরিবেশ দূষিত হয়ে ওঠে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ইচ্ছা ছিল এই লালদীঘিতে সাধারণ নাগরিকদের সন্তানদের নামমাত্র মূল্যে সাঁতার শেখার জন্য একটি সুইমিংপুল করা। তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। তবে ভুল বোঝাবুঝির জন্য কাজটি শেষ করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধনী পরিবারের জন্য অভিজাত ক্লাবে সুইমিং পুল থাকলেও সাধারণ পরিবারের সন্তানদের জন্য সাঁতার শেখার কোন সুযোগ নেই। আউটার স্টেডিয়ামের একাংশে ক্রীড়া পরিষদ একটি সুইমিং পুল তৈরি করলেও তা অপরিকল্পিত ও নির্মাণগত ত্রুটির কারণে এখন পর্যন্ত ব্যবহার অনুপযোগী। আমি সাধারণ পরিবারের কথা ভেবে তাদের সন্তানরা যাতে এখানে স্বল্পমূল্যে সাঁতার শিখতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাই। তিনি নগরবাসীর উদ্দেশে বলেন, লালদীঘি মানবিক নগর তৈরির একটি আবশ্যিক উপাদান। লালদীঘি কংক্রিটের জঞ্জালে স্বচ্ছ জল, বাহারী ফুল ও সবুজের এক টুকরো ভূস্বর্গ ভূমির প্রতি সমতা ভরা সংবেদনশীলতা সৌন্দর্য্য ও পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব নগরবাসীর আর চসিকের দায়িত্ব নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষনের। ঐ সময় পার্কে প্রাত: ভ্রমণে আসা লোকজনকে চসিকের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ডায়বেটিক, রক্তের উচ্চচাপ পরীক্ষাসহ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চসিক প্রশাসকের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম।