পারুলকে এখন সবাই মিসেস চৌধুরী নামে চেনে। প্রতিদিন তার সকাল হয় অপরাহ্ণে। সূর্যোদয় কবে দেখেছে মনেই পড়ে না। নৈশক্লাব থেকে ঘরে ফিরে স্নান সেরে শ্বেতশুভ্র সিল্কের নাইট গাউন গায়ে জড়িয়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা শয়নমন্দিরে প্রবেশ করতেই ঘড়ির কাঁটা রাত দুটো ছাড়িয়ে যায়। যেদিন নৈশক্লাব থাকে না সেদিন বাড়িতেই বসে আনন্দ আসর। সেটাও চলে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত। এভাবেই তার দিন মাস বছর গড়ায়। তবে বিদেশ সফরের সময় বিমানের সময়সূচি ধরে তাকে দিনপঞ্জিতে এদিক–ওদিক করতে হয়। ব্যতিক্রম কেবল বছরের একটি দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি।
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে বরাবর সামনের সারিতে থাকেন মিসেস চৌধুরী, যাকে অনেক কাল আগে সবাই পারুল নামে চিনত। ফেব্রুয়ারির শুরুতে বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে একুশের বিশেষ সাজপোশাক কিনে ফেলে। সূর্যোদয়ের বেশ আগেই গাড়োয়ান–দারোয়ান–খানসামা–মালি যে–যার দায়িত্ব সমাধা করে ফেলে ত্বরিত গতিতে। তিনি রওনা করেন শহীদ মিনারের পথে। পথিমধ্যে দু’এক জন বন্ধুকে সঙ্গে নেন। একসঙ্গে তাঁরা সূর্যোদয় দেখেন। তবে কয়েক বছর ধরে একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে সূর্যের দেখা মেলে না। আকাশ বড় মুখ ভার করে রাখে। কেন কে জানে! শহীদ মিনারের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যান মিসেস চৌধুরী ও তাঁর সহযাত্রীরা। ফুল হাতে হাঁটতে শুরু করেন। তার আগে জুতো জোড়া খুলে রাখতে ভুল করেন না। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে যান। প্রভাত ফেরিতে সামিল হন পর্যাপ্ত ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে। শহীদ বেদিতে উঠে বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভাষাশহীদদের প্রতি।
ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসতে সকাল ফুরিয়ে যায়। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে গাড়িতে বসে প্রকাণ্ড একটা হাই তোলেন মিসেস চৌধুরী। ফিরতি পথে যানজটের কবলে পড়তে হয়। শাপশাপান্ত করে যান অদৃশ্য কোনো শত্রুকে, প্রকারান্তরে দেশটাকেই। এই দেশে মানুষ বাস করতে পারে! ত্রিশ মিনিটের পথ দেড় ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে বাড়ির ফটক দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতে না করতেই ছুটে আসে তাঁর একান্ত সহকারী। পানি, তোয়ালে, ঘরে পরার চপ্পল নিয়ে। ধুলোমাখা পা দুটো ধোয়ামোছা হয়ে গেলে পায়ে চপ্পল গলিয়ে খাবার ঘরে যান তিনি। প্রাতঃরাশ সারেন টেবিল ভরা ইংরেজি খাবারদাবার আর ফলফলাদি দিয়ে। এরপর রাঁধুনি, আয়াদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে শয়নকক্ষের দরজা লাগিয়ে চলে যান ঘুমের দেশে। ঘড়িকে বলে দেন সময়মতো ডেকে দিতে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে বিশেষ আলোচনা সভায় বিশেষ বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত তিনি। পাঁচটার মধ্যে সভাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে।
পড়ন্ত দুপুরে শয্যা ত্যাগ করে স্নানাহার সারেন মিসেস চৌধুরী। মধ্যাহ্ন ভোজনে সামান্যই আহার করেন তিনি; হরেক রকমের ফল সহযোগে তৈরি সালাদ। এরপর আলোচনা সভার জন্য তৈরি হন। প্রভাত ফেরিতে তাঁতের শাড়ি পরলেও বিকেলের আলোচনা সভার জন্য বেছে নেন সাদা কালো জামদানী। সঙ্গে রঙ মিলিয়ে গহনা, পাদুকা, বটুয়া। বাঙালি নারীর আদর্শ প্রতিকৃতি। গাড়িতে বসে কলেজের বাংলার অধ্যাপক বান্ধবীর লিখে দেওয়া বক্তৃতার অনুলিপিতে চোখ বোলান। উহ এত কঠিন কঠিন শব্দ লিখেছে! অথচ কি আশ্চর্য একসময় তিনিও কবিতা লিখতেন! মন চলে যায় সুদূর অতীতে।
বাবা–মা ভাইবোনদের সঙ্গে তখন মফস্বলে থাকে পারুল। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মা গৃহিণী। ছোটরা সব স্কুলে পড়ছে। পারুল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, নানা অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে। প্রতিবেশির ছোট ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে কিছু টাকা আয়ও করে। কত স্বপ্ন তার! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, কাজ করবে, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসে পারুলকে। এই অসময়ে বিয়েতে কারও সম্মতি নেই। কিন্তু পিঠেপিঠি তিন তিনটে মেয়ে। ধনবান পরিবারের সুপাত্র হাতছাড়া করতে মন সায় দেয় না বাবার। অগত্যা কন্যা সমপ্রদান করেন মন ভার করে। পাত্র কথা দেয় বিয়ের পর বউ–এর লেখাপড়ায় কোনো বাধা আসবে না। বাধা আসেনি, সত্যি। পারুলেরই মন ঘুরে যায়। ঐশ্বর্যেও ছড়াছড়ি এ–বাড়িতে। মুখ খোলার আগেই সবকিছু হাতের মুঠোয়। আরাম–আয়েশ, বিলাস–ব্যসন তাকে অন্য মানুষে রূপান্তরিত করে। সে ভুলেই যায়, সকালের নাস্তায় একটা ভাজা ডিমকে চার টুকরো করে মা তাদের পাতে তুলে দিত, তা–ও প্রতিদিন না। কেনা ফল কোনোদিন ওদের বাড়িতে আসেনি। কত ঈদে নতুন জামা পায়নি ওরা ! মাকে নতুন শাড়ি পড়তেই দেখেনি।
মফস্বল শহরের সেই টানাটানির জীবনটাকে এক প্রকার মাটি চাপা দিয়েই নতুন জীবনে পা বাড়ায় পারুল। পুত্র আসে ঘরে। স্বামী লাখপতি থেকে রাতারাতি কোটিপতি বনে যায়। কিছুদিন পর রাজনীতিতে নাম লেখায়। জনসেবকের ছদ্মবেশ ধারণ করে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যায়। বাড়িতে থাকার সময় নেই তার। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী পুত্রকে মাধ্যমিকের পাঠ চুকনোর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমের এক শহরে পাঠিয়ে দেয়। প্রাসাদোসম বাড়িতে এক ঝাঁক দাসদাসী নিয়ে বসবাস করে পারুল। কুটোটি নাড়তে হয়না তাকে। চাইলেই লেখাপড়ায় মন দেওয়া যায়। কিন্তু মন চাইলেতো।
রাজনীতিতে নাম লেখানো ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সহধর্মিনী হিসেবে নানা গুরুত্বপূর্ণ সভায় যাওয়া হয় পারুলের। সেই থেকে হারিয়ে যায় তার ‘পারুল’ নাম। তিনি হয়ে যান ‘মিসেস চৌধুরী’। অনেক গুণমুগ্ধ জুটে যায় আশপাশে। বন্ধুত্ব হয় কারও কারও সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গী হিসেবে অংশগ্রহণ করা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও নানা সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ধীরে ধীরে। সেই থেকে তিনি রাতজাগা পাখি। ভোরের আলোকে নির্বাসন দিয়েছেন নিজেই।
গাড়ি অনুষ্ঠানস্থলে কখন পৌঁছে যায় বুঝতে পারে না পারুল। চালক দরজা খুলে ধরলে সহস্র আলোকবর্ষ পেরিয়ে বর্তমানে ফিরে আসেন ‘মিসেস চৌধুরী’। সভাস্থলে তাঁর মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা উপস্থিত দর্শকের মন জয় করে নেয়। অবিরাম করতালি, অভিনন্দন আর ধন্যবাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন তিনি। রাত্রি সবে আটটা। ঘরে ফিরতে মন সায় দেয় না। ঘরতো তাঁর অপেক্ষায় নেই। তাঁর ফেরা না ফেরায় কোনো কিছুই বদলায় না। যন্ত্রের মতো সব কাজ সমাধা করে ফেলে অধিনস্ত কর্মচারীরা। তবুও মাঝে মাঝে হুংকার ছাড়েন তিনি, নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে।
এই সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার কোনো মানে হয় না। কয়েকজন কাছের বন্ধুকে ডেকে নৈশ ভোজের উদ্দেশ্যে অভিজাত রেস্তোরাঁয় যান ‘মিসেস চৌধুরী’। আশ্চর্য! একুশে ফেব্রুয়ারির রাতেও এত ভিড় রেস্তোরাঁয়! একটু নিরিবিলি খুঁজতে অপেক্ষা করতে হয় কিছু সময়। মহাদেশীয় নানান পদে ভরে উঠে খাওয়ার টেবিল। ধীর লয়ে বাজে চেনা কোনো ইংরেজি গানের সুর। খাবারে মন নেই অতিথিদের। ছুরি, কাঁটা চামচ নড়াচড়া করে এক আধটু চেখে চেখে ভোজন সম্পন্ন করেন তাঁরা। কোমল পানীয়ের বোতল সবার হাতে হাতে। ঘড়ির কাঁটা এগারোতে পৌঁছায়। সঙ্গীদের তাড়া থাকলেও ‘হোস্ট’ কে কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না। একসময় তিনিই বলে ওঠেন– চলো ওঠা যাক।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে বাড়ি ফেরেন মিসেস চৌধুরী। এখনও ফেরার সময় হয়নি মিস্টার চৌধুরীর। একুশ নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই তাঁর। অন্তত চার পাঁচটি সভায় যেতে হয় তাঁকে; চেতনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে হলে বিশেষ পোশাকে বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিতির জানান দেওয়ার কোন বিকল্প নেই তাঁর।
মিসেস চৌধুরী শান্ত পায়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করেন। স্নানঘরে তাঁর জন্য সাজিয়ে রাখা আছে সুগন্ধি মোমবাতি ঘেরা মর্মর পাথরের ছোট্ট পুকুর। কুসুম–কুসুম গরম জলে পরিপূর্ণ সেই পুকুরে গা ডুবিয়ে বসে থাকেন অনেকটা সময়। শ্বেতশুভ্র রাতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে আকাশ দেখেন। অদূরের সড়ক হতে নানা প্রকারের গাড়িদের টানা আর্তনাদ ভেসে আসছে। সবাই কেবল ছুটছে আর ছুটছে। এই শহর মানুষের চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
ঘুম নেই তাঁর চোখেও। আজ অবশ্য সময় নিয়ে কোনো ভাবনা নেই মিসেস চৌধুরীর। আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে সূর্য ওঠার আগে শয্যা ত্যাগ করতে হবে না।
ড. সালমা বিনতে শফিক, অধ্যাপক
ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়