কোনো কোনো মানুষ সাম্প্রতিক সময়ে তার পরিবারের সদস্যদের মতো অতি আপন মানুষের ঘাতক হয়ে উঠছে। উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে পারিবারিক সহিংসতা। কোথাও জেদের বশবর্তী হয়ে স্ত্রী নির্মমভাবে হত্যা করছেন স্বামীকে, স্বামী মেরে ফেলছেন স্ত্রীকে। আবার সবচেয়ে নিরাপদ যে মায়ের কোল, সেই মা হয়ে যাচ্ছেন সন্তানের হন্তারক; অন্যদিকে সন্তানকে খুন করে পালিয়ে বেড়ান বাবা। ক্ষোভ বা লোভের বশে মা-বাবার রক্তে হাত রঞ্জিত করা সন্তানের সংখ্যা আরও বেশি। ভাই মেরে ফেলছে বোনকে, বোন ভাইকে। গত ১৬ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে ‘দুই সন্তানকে হত্যা করে মায়ের আত্মহত্যা’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাত বছরের জান্নাত মাইমুন ও আড়াই বছরের সান বাবু। বাবা সোহেল রানার (৩৭) চেয়ে মা সুমিতা খাতুনের (২৭) সঙ্গে তাদের সময় কাটত বেশি। কারণ মা-ই তাদের ভালোবাসতেন বেশি। সেই মা সুমিতা খাতুনই তার আদরের দুই সন্তানকে হত্যা করেন এবং নিজেও নাইলনের দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন মোহাম্মদপুর এলাকার ইসমাইল কলোনির একটি ভবনে এ ঘটনা ঘটে। এসএস হাউজ নামের ৮ তলা বিল্ডিংয়ের ৪ তলার একটি ফ্ল্যাটে ওই দম্পতি ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন। পরে খবর পেয়ে গত শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ওই ফ্ল্যাটের মূল দরজা ও একটি বেডরুমের দরজা ভেঙে মা ও দুই শিশু সন্তানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় মা ও জান্নাত মাইমুন ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় এবং আড়াই বছরের সান বাবুর নিথর দেহ খাটে শুয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লাশ তিনটি ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের ধারণা, এটি হত্যাকাণ্ড নয়। পারিবারিক কলহের জেরে দুই সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন মা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবার মানব সমাজের মৌল ভিত্তি। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ইত্যাদি পারিবারিক সুস্থতা ও দৃঢ়তার উপরই বহুলাংশে নির্ভরশীল। যদি পারিবারিক জীবন অসুস্থ ও নড়বড়ে হয়, তাতে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তাহলে সমাজ জীবনে নানা অশাস্তি ও উপদ্রব সৃষ্টি হতে বাধ্য। এ কারণে সমাজ-বিজ্ঞানীরা পারিবারিক জীবনের সুস্থতা ও সুষ্ঠুতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এই সুস্থতা ও সুষ্ঠুতা আসবে কিভাবে? কেন অশান্তি বিরাজ করে পরিবারে? কেন এমন সহিংসতা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক কারণেই পারিবারিক অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ অশান্তি থেকেই যত বিপত্তি, যত প্রাণঘাত। অশান্তির নেপথ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির লোভ, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, সাংসারিক অনটন, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, বহিরাগত রাষ্ট্রের সংস্কৃতির আগ্রাসন, ভোগ-বিলাসিতার আকাঙ্ক্ষা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও মাদকাসক্তি ছাড়াও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তাঁরা।
বলা যেতে পারে, সামগ্রিক অসহিষ্ণুতার কারণেই পারিবারিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আকাশ-সংস্কৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অযাচিত ব্যবহারও অন্যতম একটি কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যৌথ পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়াও এমন অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলকভাবে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে এনজিওগুলোকেও চাইলে সরকার কাজে লাগাতে পারে। পারিবারিক অস্থিরতা বিরাজ করলে তা শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ক্রমান্বয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, মানুষ এখন কেমন যেন লোভী হয়ে গেছে। আইন-কানুন না মেনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ ভাই-বোন ও পিতা-মাতাকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। এক ভাই শক্তিশালী হলে দুর্বল ভাইয়ের প্রতি অন্যায়-অবিচার করছে। এতে অন্য ভাইটি হয় অপর ভাইকে হত্যা করবে, না হয় হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেই আত্মহত্যা করবে। এগুলো সমাজে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে। কাজেই হত্যা-আত্মহত্যা রুখতে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।