পারিবারিক সহিংসতা : প্রশাসনকে আরো সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে

| শুক্রবার , ১২ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

গত ১০ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদ সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘তৃতীয় স্ত্রীর সহায়তায় চতুর্থ স্ত্রীকে খুন/আশ্রয় দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে, দেড় বছর পর ধরা’ শীর্ষক সংবাদটির মাধ্যমে যেমন সমাজের পারিবারিক সহিংসতার চিত্র ফুটে উঠেছে, তেমনি অবক্ষয়ের স্বরূপ উন্মোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া করণীয় বিষয়ে মতৈক্য তৈরি ও জনমত প্রতিষ্ঠার ওপর আলোকপাত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, তৃতীয় স্ত্রীর সহায়তায় চতুর্থ স্ত্রীকে খুন করে আশ্রয় নিয়েছিলেন খুনি দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে। দেড় বছর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঁচতে পারলেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত পুলিশের পাতা ফাঁদে ধরা পড়লেন সোহাইল আহমেদ ও সহায়তাকারী তার তৃতীয় স্ত্রী নাহিদা আক্তার। চাঞ্চল্যকর এ খুনের রহস্য উন্মোচন করে হালিশহর থানা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে গ্রেপ্তারকৃত সোহাইল ও নাহিদা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম) পঙ্কজ দত্ত। নিহত আফসানা পতেঙ্গা থানার ডুরিয়া পাড়া এলাকার মনিরের বাড়ির মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে।
গত বছরের ২১ জুলাই নগরীর হালিশহর রহমানবাগ আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসার কক্ষ থেকে তালা ভেঙে মুখ বিকৃত অবস্থায় পচতে শুরু করা ২৫ বছর বয়সী এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় ওই নারীর স্বামীর দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ছাড়া কোনো ক্লু ছিল না পুলিশের কাছে। সেখানে নিজের নাম গোপন করে রেজাউল করিম বলে পরিচয় দিয়েছিলেন সোহাইল।
লাশ উদ্ধারের পর থেকেই স্বামীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি একের পর এক সিম বদলিয়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে থাকেন। দেড় বছর পর অজ্ঞাত সেই নারীর স্বামীকে শনাক্ত করে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বাগেরহাটের মংলা থেকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্য অনুসারে তৃতীয় স্ত্রীকে পতেঙ্গা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান বা আয়না। যা আমাদের প্রকৃত শিক্ষালয় হিসেবে বিবেচিত। আমরা এখান থেকেই জীবনের সবকিছু শিখতে পারি। সমাজে চলতে ফিরতে সবকিছু প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকে শিখি। পরিবারের সব সদস্যের অধিকার সমান। সে ছোট হোক কিংবা বড়। সবার মর্যাদা যথাযোগ্য। পরিবারের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার উন্নত সাধিত হয়। কারণ পরিবার ছাড়া সমাজব্যবস্থা অর্থহীন। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, এই পরিবারকে ঘিরে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকে। যা পারিবারিক সহিংসতা নামে পরিচিত আমাদের মাঝে। সহিংসতা অর্থ হিংসাযুক্ত আচরণ বা অমানবিক আচরণ। হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের প্রতি যে আচরণ করে তাই সহিংসতা হিসেবে পরিচিত। পরিবারের এক সদস্য কর্তৃক অপর সদস্য সহিংসতা আচরণ বা অমানবিক আচরণের শিকার হন।
আমরা শুনে আশ্চর্য হই যে, দেশে নারীদের প্রতি তিনজনের একজন পারিবারিক সহিংসতার শিকার। সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের মাত্র তিন ভাগের মতো বিচার পান। এসব ঘটনায় মামলা হয় মাত্র ১০ শতাংশ। অধিকার সংস্থা অ্যাকশন এইডের এক গবেষণায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়, প্রচলিত ধারণা এবং পিতৃতান্ত্রিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস হচ্ছে ‘নারীরা ঘরেই বেশি নিরাপদ’।
কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে নারীদের প্রতি বেশির ভাগ সহিংসতা বাড়িতে সংঘটিত হয়। ঘরের প্রতি তিন জনের মধ্যে দুই জন নারীই নানাভাবে পরিবারের লোকজনের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন।
এ গবেষণায় বলা হয়েছে, নারীরা ঘরেই বেশি নিরাপদ এই প্রচলিত বিশ্বাস এমন একটি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে, জনপরিসরে নারী নিরাপত্তাকে তা আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এখন পর্যন্ত কোনো আইনই এটা মানতে রাজি নয় যে, বিয়ের পর নারীরা ধর্ষণের শিকার হতে পারে। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলোর প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটি মামলাই আদালতে উত্থাপিত হতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তারপর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৩ দশমিক ১ শতাংশ নিজেদের পক্ষে বিচার পায়, ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির পর্যায়ে যায় না বা গেলেও বাতিল হয়ে যায়।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, নারীদের প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি এটা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। এটা শুধু আমাদের দেশের নয় এটা বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সচেতন হতে হবে। সবাইকে সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনকে আরো সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রশাসন যদি সচেতন হয় তাহলে আরো গভীরভাবে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে