পারমাণবিক জ্বালানির যুগে বাংলাদেশের পদার্পণ

‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার আরেকটি পদক্ষেপ’

| রবিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

পারমাণবিক জ্বালানির যুগে বাংলাদেশের পদার্পণকে আমরা স্বাগত ও অভিনন্দন জানাই। ৬ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েলে’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভার্চুয়ালি উপস্থিতিতে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র এ পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণ করে। কর্তৃপক্ষের কাছে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি হস্তান্তর করার ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারকারী ও দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারকারী রাষ্ট্র। রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (আরএনপিপি) সাইটে একটি অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের কাছে জ্বালানি সরবরাহের সনদ ও জ্বালানি সমাবেশের মডেল হস্তান্তর করেন। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মস্কোর ক্রেমলিন থেকে ভার্চুয়ালি যোগদান করেন। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের আরেকটি পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র দৃঢ় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতীক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। এই পারমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার আরেকটি পদক্ষেপ। তিনি বলেন, আমরা এটাই মনে করি, আজকের বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা নিউক্লিয়ার যুগে প্রবেশ করেছি।

এদিকে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, এই প্রকল্পে উভয় দেশেরই স্বার্থ রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় বিরাট অবদান রাখবে। বাংলাদেশকে পরীক্ষিত বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে রুশ প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, পারস্পরিক সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুতিন বলেন, ৫০ বছর আগে রাশিয়া ও বাংলাদেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তুত দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সরবরাহ অপরিহার্য। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সোপানে পদার্পণ করেছে। এদিকে ভিশন২০৪১ তথা উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে প্রায় ষাট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্নের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং সেটাকে ধরে রাখতে বিদ্যুতের বিকল্প নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদার আলোকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১০ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান হালনাগাদ করে। হালনাগাতকৃত পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী একক কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে মিশ্র উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা মিশ্র জ্বালানি উৎস নীতি গ্রহণ করা হয়। বস্তুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে মিশ্র জ্বালানি উৎস নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকে অন্যতম উৎস হিসাবে ধরা হয়।

ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি থেকে আবার ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি পাওয়া যায় বিধায় অনেকে এই জ্বালানিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবেও অভিহিত করেন। তেল গ্যাস বা কয়লার মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের কোনো সুযোগ নেই। এটিকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী ও নির্মল বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রযুক্তি বলা হয়।

তবে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটলে এর থেকে যে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে সেটি প্রাণ প্রকৃতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়। কারণ এই তেজস্ক্রিয়তা বছরের পর বছর ধরে ক্রিয়াশীল থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। তাই নিরাপত্তাই হলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে আলোচিত এবং উদ্বেগের ইস্যু। এ কারণে পারমাণবিক জ্বালানি এমনভাবে তৈরি, সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ব্যবহার হয় যাতে এটি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে না পড়ে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য স্থাপিত নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের বহু স্তর নিরাপত্তার প্রথম ধাপটি হলো ফুয়েল পেলেট। এই ফুয়েল পেলেট সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়। ফলে তেজস্ক্রিয়তা পেলেটের ভেতরেই আবদ্ধ থাকে। এছাড়া দ্বিতীয় ধাপে এই পেলেট জিরকোনিয়াম অ্যালয়ের তৈরি আস্তরণ দ্বারা মোড়ানো থাকে। কোনো কারণে তেজস্ক্রিয়তা ফুয়েল পেলেট থেকে বের হলেও আস্তরণ ভেদ করতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য আমরা পৃথক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেছি। যে কোনো ধরনের দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটা খেয়াল রেখে এই প্ল্যান্টের ডিজাইন প্রণয়ন এবং নির্মাণ কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। তাছাড়া, ব্যবহৃত জ্বালানি (স্পেন্ট ফুয়েল) ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছি। রাশিয়ান ফেডারেশন এসব স্পেন্ট ফুয়েল তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে বলে আমাদের কথা দিয়েছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, নিউক্লিয়ার ফুয়েলের শক্তি অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এই ক্ষুদ্র আকারের মাত্র সাড়ে চার গ্রাম ওজনের একটি ইউরেনিয়াম পেলেট যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে তার জন্য কয়লা লাগবে ৪শ কেজি , গ্যাস লাগবে ৩৬০ ঘনমিটার। আর ডিজেলের মতো জ্বালানি পোড়াতে হবে সাড়ে তিনশ কেজি। অর্থাৎ এক কেজি নিউক্লিয়ার জ্বালানির সক্ষমতা ৬০ টন জ্বালানি তেল আর ১শ টন কয়লার সমান। তাই এর সুফল আমরা পাবো সেই প্রত্যাশা রাখতে পারি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে