এবারের উচ্চমাধ্যমিক বা এইচএসসির ফলাফল প্রকাশিত হবে খুব শীঘ্রই। আমরা সবাই জানি সরকারি সিদ্ধান্তমতে ছাত্রদের জেএসসি ও এসএসসি ফলাফলের ভিত্তিতে হবে এবারের এইচএসসি ফলাফল। এসএসসির ফলের ৭৫ শতাংশ এবং জেএসসির ২৫ শতাংশ গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করা হবে। ফলাফল প্রকাশ পরবর্তী যে ব্যাপারটা আলোচনায় সেটা হচ্ছে এসমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের স্নাতক ভর্তি নিয়ে। বরাবরের মতোই ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সিট সংখ্যা অপ্রতুল। এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী প্রায় ১৩ লাখ ৬৫ হাজার, যাদের সবাই পাস করবে।
এই সমস্ত শিক্ষার্থীরা পাবলিক, প্রকৌশল ও মেডিক্যাল সহ ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪ হাজার আসনে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির যুদ্ধে নামবেন। অন্যান্য বারের তুলনায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
এসব চাপিয়ে আলোচনার ইস্যু হলো ভর্তি পরীক্ষার ধরণ নিয়ে। গত কয়েকবছর ধরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাত্র ও অভিভাবকদের কষ্ট লাঘবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষার কথা বলে আসছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এর প্রতি নির্দেশনা আছে এই প্রক্রিয়াটা বাস্তবায়নের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা চললেও বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আপত্তিতে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে
কাজ যে একেবারে হয়নি তা নয়। যতদূর জানা যায়, গতবার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সফলতার সাথে গুচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছিল। সরকারের নির্দেশনা মতে ইউজিসি চেষ্টা করছে বাকী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকেও গুচ্ছ পদ্ধতিতে আনতে, কিন্তু অনেকের তাতে আপত্তি। উনাদের ধারণা এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতির স্বকীয়তা হারিয়ে যাবে। অনেকেই মনে করেন প্রশ্নফাঁসের যুগে সুনাম ও ঐতিহ্য ধরে রেখে পরীক্ষা নেওয়া, গুচ্ছ বা একসাথে হলে সম্ভব নয়। এবছর করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সমন্বিত পরীক্ষার তোড়জোড় চালালেও বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে নিজেদের মতো পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আশার কথা হলো, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সমপ্রতি ১৯টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসে। সরকারের এত পদক্ষেপের পরও দেশব্যাপী ঘুরে পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির পাশাপাশি অর্থ খরচ ও হয়রানি হবে। কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে শিক্ষার্থীদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে হলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে।
পরীক্ষা অনলাইন না অফলাইন তাও একটা বড় ফ্যাক্টর। সত্যি বলতে বর্তমান বাস্তবতায় এত বড় কাজ অনলাইনে করতে গেলেও অনেক সমস্যা। এর মধ্যে সততার প্রশ্ন প্রথমেই আসবে, দ্বিতীয়ত প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দেশব্যাপী একই রকম নয়। বিশ্বের অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আভ্যন্তরীণ পরীক্ষা নেওয়ার নিজস্ব প্রোক্টরড এঙামিনেশন সিস্টেম বা একইরকম অন্যান্য সফটওয়্যার ব্যবহার করে বর্তমান অবস্থায় পরীক্ষা হচ্ছে। তবে এধরনের সফটওয়্যার দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার মতো এত বিশাল সংখ্যক ছাত্রের পরীক্ষা নেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের দেশে এখনও তৈরি হয়নি। যদিও ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়, তবে এর ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। বিদ্যমান নেটওয়ার্ক এবং টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন সঠিক নাও হতে পারে। অন্যদিকে অফলাইনে বর্তমানে বড় সমস্যা কোভিড সংক্রমণ এর মাত্রা। এক্ষেত্রে করোনার যে সেকেন্ড ওয়েভ চলছে তার প্রকোপ একটু কমে আসলে অফলাইন সমন্বিত পরীক্ষার চিন্তা করা যায়। কারণ এধরনের পরীক্ষায় চ্যালেঞ্জ হবে সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া। যেহেতু এটা ভর্তির ব্যাপার অনেকে সংক্রমিত হলেও কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষার হলে এসে বাকীদেরকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিবে। সমপ্রতি আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষায় এ ধরনের একটি ঘটনা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করা গেছে। একজন মহিলা পরীক্ষার্থী কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পরেও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেন যা অন্য যারা সুস্থ তাদের জন্য আতংকের ব্যাপার।
বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তির ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। অনেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে। ভর্তি কার্যক্রম ফলাফল প্রকাশের পরই শুরু হয়ে যাবে হয়তো। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের যোগ্যতাও ঠিক করে ফেলছে। সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৭, বাণিজ্যের শিক্ষার্থীদের জিপিএ সাড়ে ৬ এবং মানবিকের শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৬ থাকতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন একই স্ট্যান্ডার্ডের হলেও প্রশ্ন হবে বিভিন্ন সেটে। উচ্চ মাধ্যমিকের কমন সাবজেক্টগুলো থেকেই প্রশ্ন হবে। কমিটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি স্কোর দেবেন। গুচ্ছের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ শর্ত ও চাহিদা উল্লেখ করে শিক্ষার্থী ভর্তি বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে। স্কোর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করবে। এজন্য আলাদা করে কোনো ধরনের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নিজেদের কথা চিন্তা করে ভর্তির নিজস্ব কিছু সময়োপযোগী পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার আউটগোয়িং ব্যাচগুলোর পরীক্ষা নেওয়ার তোড়জোড় চলছে। উদ্দেশ্য একটাই, কোভিড এর কারণে শুধুমাত্র আটকে থাকা পরীক্ষাটা যেন শেষ করে তাদেরকে কার্যক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া। এক্ষেত্রে ও সমস্যা অনলাইন-অফলাইন নিয়ে। যেহেতু প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এঙিটটিং নিজস্ব পরীক্ষা পদ্ধতি আছে, এবং কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভবপর সেক্ষেত্রে অফলাইনের দিকে এগুচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অবশ্য ইউজিসির নির্দেশনা এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকেও মানতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। ছাত্রদের একাডেমিক ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিগত সিদ্ধান্ত দিবে একাডেমিক কাউন্সিল। এ ফোরামে শিক্ষকরা সাধারণত শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
কিছু কিছু শিক্ষার্থী অনলাইনের পক্ষে থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় অফলাইনে পরীক্ষা হলেই ভবিষ্যতে এসব শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট নিয়ে কোন ধরনের বিতর্কের মুখোমুখি হতে হবে না দেশে অথবা বিদেশে। তবে শর্ত থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষাসমূহ নেওয়ার ব্যবস্থা করে। যেহেতু ইউজিসির নির্দেশনায় হলগুলো বন্ধ তাই দূরদূরান্তের ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি থেকে পরীক্ষা দেওয়ার যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা ও সুযোগটা করে দিতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে তাদের বন্ধুদের, সিনিয়র/ জুনিয়রদের জরুরি আবাসিক সমস্যা সমাধানে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন- শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার সার্বিক সহযোগিতায় পরীক্ষাকার্য সমাধান হলেই সবার মধ্যে একধরণের সন্তুষ্টি বিরাজ করবে। আনন্দের খবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটগোয়িং ব্যাচের পরীক্ষা সবার সার্বিক সহযোগিতায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইউজিসি নির্দেশনা মোতাবেক চলমান।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ( চুয়েট)।