পাপিয়ামেন্তো (Papiamento) কারো নাম নয়; এক জাতিগোষ্ঠীর ভাষার নাম। আজ বলি আমি কীভাবে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। আল্লাহ্ এই দুনিয়ায় অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা সৃষ্টি করে রেখেছেন। অনেকেই প্রশ্ন করেন–এত দেশ ঘুরেছেন, কোন্ জায়গাটা সবচেয়ে সুন্দর? আমার উত্তর–দুনিয়ার সব জায়গায়ই নিজগুণে সুন্দর। কাশ্মীরকে ছোটবেলা থেকে ভূস্বর্গ বলেই জেনে এসেছি–সেই নামকরণটা আমাদের উপমহাদেশীয়দের মধ্যেই। কাশ্মীর অবশ্যই সুন্দর, কিন্তু এর থেকেও অনেক সুন্দর জায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার প্রথম সারির পছন্দের মধ্যে এই এবিসি অবশ্যই পড়বে, যেখানের ভাষা পাপিয়ামেন্তো।
১৯৯১ সালের ১৬ জানুয়ারিতে আম্মার জন্মদিন পালন করে, পরদিনই প্লেনে চেপে ঢাকা এবং সেখান থেকে থাই এয়ারওয়েজে ব্যাঙ্কক। আমার গন্তব্য কখগ–এর ফ্লাইটে ব্যাংকক থেকে এমস্টার্ডাম হয়ে কুরাসাও (Curacao) যাবো। কিন্তু ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে জানালো যে, আমাদের প্লেন যান্ত্রিক গোলযোগের জন্যে এমস্টার্ডাম থেকে আসতে পারেনাই। সব প্যাসেঞ্জারদের এয়ারপোর্ট বিল্ডিং লাগোয়া হোটেল দিবে। প্লেন আসলে, তখন আবার রওনা দিবে। কতক্ষণ দেরী হবে কখগ–এর ব্যাংকক কাউন্টারের কেউই সেটা জানে না। একে একে সকল প্যাসেঞ্জারই হোটেলের ভাউচার নিয়ে চলে গেলো। আমিও আমার ভাউচারটা নিয়ে ইমিগ্রেশান পার হতে গিয়ে আটকে গেলাম। তুমি বাংলাদেশী? বাংলাদেশীদেরকে এরকম অন–এরাইভ্যাল এন্ট্রি–ভিসা দেওয়া যাবে না। তাহলে আমি কী করবো? এয়ারপোর্টে সময় কাটাও। এবারে আমি এরকম বৈষম্যের জন্যে জোরগলায় প্রতিবাদ জানিয়ে, কৈফিয়ত চাইলাম। আমার গন্তব্যস্থানের ফুল–টিকিট দেখালাম, আর তাকে অভিহিত করে দিলাম আমি মেরিনার, জাহাজে জয়েন করতে যাচ্ছি। এয়ারপোর্ট, ইমিগ্রেশানে রিটার্ন টিকিটের বদলে ওয়ান–ওয়ে টিকিট থাকলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। মেরিনাররা জাহাজে জয়েনিং–এর সময়ে, এবং বাসায় ফিরে আসার সময়ে–প্রতিবারেই ওয়ান–ওয়ে টিকিট ব্যবহার করে। আমি বললাম, আমার জেনুইন, অথেন্টিক, ফুল–পেইড টিকিট এবং হোটেল–ভাউচার থাকার পরেও কেন আমার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে? আমি তার ম্যানেজার বা সুপারভাইজারকে ডাকতে বললাম। এবারে তারা ঘাবড়ে গিয়ে, অপ্রস্তুতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, আমাকে স্পেশাল–কেস্ দেখিয়ে ভিসা দিয়ে দিলো। আশি–নব্বইয়ের দশকে, ব্যাংককের এয়ারপোর্ট হোটেলটা বিশ্বের লাক্সারি হোটেলের একটা অন্যতম ছিলো, যদিও ২০১০–১৫ সালের দিকে আবারো গিয়ে আমার কাছে সেটা আর একদমই পছন্দ হয়নাই।
যাহোক, সারারাত হোটেলে কাটানোর পরে, সকালে ফোনে তারা জানান দিলো, দুপুর নাগাদ প্লেন আসবে। সেইমত এয়ারপোর্টে যেতে হবে–ব্রীজ বা ওয়াকওয়ে পার হলেই এয়ারপোর্ট বিল্ডিং–এ টিকিট কাউন্টার। তখনকার দিনে এত এত টিভি–ক্যাবল নেটওয়ার্ক ছিলো না, আর ইন্টারনেট যে কি; সেটা তো কেউই জানতাম না। হোটেলে টিভিতে খবর দেখি নাই। দুনিয়ায় সেদিন কি হচ্ছে, তার কিছুই জানতাম না। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম–প্লেনের স্ক্রিনে যে Flight-Tracker দিয়ে প্লেনের ভৌগোলিক অবস্থান, গতিমাত্রা ইত্যাদি দেখায়; সেখানে প্লেনটা সোজাপথে ব্যাংকক থেকে এমস্টার্ডাম না উড়ে, অনেক ঘুরে এশিয়া–মাইনর, রাশিয়া ঘুরে গেলো। এরপরে, আমি এমস্টার্ডামে প্লেন বদলে ক্যারিবিয়ান সি–র মাঝে নেদারল্যান্ড্স্ লেসার–এন্টিলিস–এর অতুলনীয় সুন্দর দ্বীপ, কুরাসাওতে নামলাম। ম্যাপে দেখবেন ভেনিজুয়েলার অল্প একটু উপরে ক্যারিবিয়ান সাগরে তিনটা দ্বীপ; সেই তিনটার নামের অদ্যাক্ষর থেকে, এদেরকে বলে ABC–আরুবা (Aruba), বোনেইর (Bonaire) এবং কুরাসাও (Curacao)। টুরিস্টদের জন্যে এগুলো স্বর্গরাজ্য ক্যারিবিয়ানের উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া, সুন্দর চিনির মত সাদা মিহি বালুর সি–বিচ, আমোদ–প্রমোদের ব্যবস্থা, বার–রেস্টুরেন্ট আর ঐতিহাসিক স্থান। কিন্তু, তার থেকেও বেশি চোখ কেড়েছিলো – হাজার হাজার ফুট উঁচুতে প্লেন আকাশে থাকতেই দ্বীপগুলোর বিচ ও সেখানের পান্না–সবুজ স্বচ্ছ কাঁচের মত পানি। এতই স্বচ্ছ যে, অত উপরে উড়ন্ত প্লেন থেকেই পানির ভিতর দিয়ে সমুদ্রের তলদেশের চিনির মত সাদা বালু মাইলের পর মাইল দেখতে পেলাম। সূর্যের আলো সেখানে ঠিকরে পড়ে সেই দৃশ্যকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। আমি দ্বীপগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দুনিয়ার অনেক অনেক সুন্দর স্থান ঘুরে বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার; কিন্তু এই এবিসি দ্বীপ তিনটা আমার মতে টপচার্টে উপরের দিকেই থাকবে।
এয়ারপোর্টে কোম্পানির এজেন্ট রিসিভ করে হোটেলে তুললো। দ্বীপের সব হোটেলই ট্যুরিস্টদের জন্যে এক একটা নৈস্বর্গিক রিসোর্ট–বিচের পাশে টিকি–হাট। আমোদ–প্রমোদ ভ্যাকেশানের জন্যে পারফেক্ট স্পট। হোটেলে থিতু হয়ে বসে টিভি অন করেই টের পেলাম আমি বাসা ছাড়ার পরে দুনিয়ায় গত কয়েক ঘন্টায় বেশ বড়সড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। অ্যামেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকে আক্রমণ শুরু করেছে। এটা ১৯৯১ সাল, বাবা বুশ প্রথম ইরাক–যুদ্ধ আরম্ভ করলো, কারণ ইরাকী সৈন্যরা কুয়েতে আগ্রাসন চালিয়ে সে দেশে ঢুকে গেছে। প্রেসিডেন্ট বুশ কুয়েত থেকে ইরাকীদের হটানোর লক্ষ্যে এই আক্রমণ চালালো। এবারে বুঝলাম আমাদের প্লেন কেনো এমস্টার্ডাম থেকে ব্যাংকক আসতে পারে নাই–অবশ্যই সেটা যান্ত্রিক ত্রুটির জন্যে নয়। কারণ, সেই মুহূর্তে শত শত মিসাইল–বোমা উড়ছে কুয়েত–ইরাকে; আকাশে ফাইটার জেট ইত্যাদি। তার ফলে, কমার্শিয়াল ফ্লাইটের জন্যে সেই এয়ারপ্যাসেজ বন্ধ। অনেকক্ষণ ধরে টিভির খবর গিলে গিলে খেলাম। প্রতি দশ–পনেরমিনিট পরপরই একটা না একটা আপডেট দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে, বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে বাইরে বিচে হাঁটতে বের হলাম। মনে হলো সিদ্ধান্তটা ভালই ছিলো। মানুষের বিনোদনের জন্যে কতকিছুর যে ব্যবস্থা আছে, সকলের সবধরনের রুচি ও পছন্দের কথা চিন্তা করেই সব করেছে। একদিকে বিচ ভলিবল, অন্যদিকে সাইক্লিং (একক, জোড়া, ট্যান্ডেম করে গ্রুপ সাইক্লিং)। অনেক ধরনের শো হচ্ছে সার্কাস, বা গানের গ্রুপ। পানির এক্টিভিটি তো আছেই–সমুদ্রস্নান, স্কুবা–স্নোর্কেলিং, সূর্যস্নান থেকে শুরু করে, সার্ফিং, বোট–ইয়্ কায়াকিং, সেইলিং– কী নাই। আমি দুইদিনের জার্নিতে ক্লান্ত, আর সে–যুগে এগুলোকে ভালোমত রপ্ত করে উঠি নাই, তাই বিচে ঘুরে ঘুরে অন্যদেরকে মজা করতে দেখলাম। দিনশেষে একা একা বসে সূর্যাস্ত দেখলাম।
সন্ধ্যায় অবশ্য একটু অটোম্যাটিক লাক্সারি হয়ে গেলো। জাহাজে জয়েনিং–এর জন্যে বাসা থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে, কয়েকমাস জাহাজে কাজ শেষ করে, বাসায় আবার ফিরে আসা অবধি আমাদের খরচ কোম্পানি বহন করে। প্লেনের টিকিট, হোটেল এবং থাকা–খাওয়া সবই কোম্পানির পয়সায়। তো সে সন্ধ্যায় রিসোর্ট হোটেলে, বীচের বালুর উপরে টেবিল পেতে, ডিনারের সময়ে একটা নাচ–গানের শো হলো। রেগী (reggae), রাস্তাফারিয়ান (Rastafari) এ–সমস্তের উৎপত্তি সেই দ্বীপগুলোতে না হলেও, সেই অঞ্চলেরই; তাই তাদের গানে ও নাচে সেগুলোর প্রভাব অনেক। বিশাল বিশাল ড্রামের তালে–তালে, মার্শাল–ড্যান্স শো–র মত এক্রোব্যাটিক নাচ–গান ও সার্কাসের মতই আগুন নিয়ে খেলা ইত্যাদি হোটেলে থাকার সুবাদে দেখে ফেললাম; অপ্রত্যাশিতভাবে ভালই সময় কাটলো। তখনই জানতে পারলাম এবিসি দ্বীপ তিনটায় ক্রিওল ভাষার সঙ্গে স্প্যানিশ–পর্তুগীজ মিশিয়ে, নতুন একটা ভাষা জন্ম নিয়েছে–পাপিয়ামেন্তো। এটা তাদের অফিসিয়াল ভাষা। ক্রিওল (Craole) মানে– ইউরোপিয়ান (প্রধানত: ফ্রেঞ্চ, ডাচ্ ও স্প্যানিশ) এবং আফ্রিকান বা ক্যারিবিয়ানদের মিশ্রণে যে দো–আঁশ্লা জাতের উদ্ভব হয়েছিলো, সেই জাত–গোষ্টির নাম। এক টুরিস্টের টি–শার্ট দেখলাম সেই পাপিয়ামেন্তো ভাষাশিক্ষার অনুবাদক–সেখানে হ্যালো, থ্যাঙ্কইউ ইত্যাদি কয়েকটা কমন শব্দের ইংরেজি থেকে অনুবাদ লেখা।
জার্নির ক্লান্তিতে, ও টাইম–জোন বদলানোর ফলে ঘুমের ঘোরে প্রথমদিন সকালে ব্রেকফাস্টে কী খেয়েছিলাম সেটা টেরই পাই নাই। দ্বিতীয়দিন খেয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম। অনেক অনেক সুস্বাদু ফল–ফলারি ছিলো। আনাড়ি–অনভিজ্ঞ আমি তখন, সেগুলোর অনেক ফলই চিনতাম না; কিন্তু খেতে খুবই ভালো লেগেছিলো। যা হোক, আর কিছুক্ষণ পরে কোম্পানির লোকাল এজেন্ট এল আমাকে নিতে। সে জানালো, প্ল্যানে একটু পরিবর্তন–জাহাজ কুরাসাও না এসে অন্য দ্বীপ–বানেইর গেছে। আমাকে সেখানে যেতে হবে। কীভাবে? ফ্লাই করে। খুব বেশি দূর নয়, কিন্তু নিজস্ব বোট/ইয়ট না থাকলে প্লেনই হলো একমাত্র উপায়। সেই প্লেনও ছোট্ট ফড়িং–এর মতো, কয়েকজন মাত্র প্যাসেঞ্জার নিয়ে রওনা দিয়ে আধা ঘন্টায়ই বোনেইর পৌঁছে গেলো। সেবারে আর বোনেইর দেখার সুযোগ হলো না। আমি প্লেন থেকে নেমে সরাসরি জাহাজে। সেই জাহাজের নাম ছিলো M.T. Esperanza – এম টি দেখে বুঝতেই পারছেন এটা তেলের ট্যাঙ্কার।
refayet@yahoo.com