এক বেলা খাবারের জন্য তিন-চার মাইল হাঁটতে হয় দশ বছরের মামুন আর ছয় বছরের সোহাগকে। পান-সিগারেটের ডালা নিয়ে হাঁটতে হয় আরো বেশি। সারা দিন নানা পথে ঘুরতে হয় তাদের। সারা দিন পরিশ্রম করে রাত কাটে একটি ঘরে। রাতভর বেঘোরে ঘুমায়। সকালের সূর্য ওঠার পর আবার শুরু হয় পথ চলা। এভাবেই ঘুরতে থাকে ওদের বিবর্ণ জীবনের দিনপঞ্জি।
লাকসামের কাইততলা গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুম পরিবার নিয়ে কয়েক বছর আগে এসেছিলেন চট্টগ্রাম নগরীতে। বছর খানেক আগে দুই পুত্র সন্তান মামুন ও সোহাগকে রেখে মারা যান স্ত্রী তসলিমা। এরপর থেকে মাতৃহীন সংসারে মামুন ও সোহাগের দিন কাটছে। মামুনের বয়স দশ বছর। ছোট ভাই সোহাগের বয়স ছয় বছর। নগরীর বিআরটিসি এলাকার একটি বস্তিতে বাবা ও দুই ভাই থাকে। মাসিক তিন হাজার টাকা ভাড়ায় এক কক্ষের একটি বাসায় তিনজনের বসবাস। সকাল থেকে রাত এগারটা অব্দি তারা বাইরেই কাটায়।
গলায় পান-সিগারেটের ডালা নিয়ে নগরীর রাজপথ ও অলিগলিতে ঘোরে। তার বাবা মাসুমও পান-সিগারেট বিক্রি করেন। তবে তাদের গন্তব্য আলাদা। বাবা এক রাস্তায় গেলে সন্তান অন্য রাস্তা ধরে। মামুনের পাশে থাকে তার ভাই সোহাগ। কখনো ভাইয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরে নেয়। রাস্তা থেকে কিছু কুড়িয়ে নেয়। আবারও ভাইয়ের পাশে ছুটে আসে। ভাই গলা ছেড়ে বলে, পান, সিগারেট…। মাঝেমধ্যে সোহাগও চিৎকার দেয়।
মামুনের ডালায় ছয়-সাত হাজার টাকা পুঁজি রয়েছে। পান-সিগারেটের অনেক দাম। ডালার পাশাপাশি খোপের ভেতরে সিগারেটের কিছু প্যাকেট থাকার কথা জানাল মামুন। ডালার ওজনও কম নয়। দশ বছরের মামুনের জন্য এই ওজনটি একটু বেশিই। কিন্তু উপায় নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই ওজন বয়ে বেড়াতে হয় তাকে। কোনোদিন এক হাজার টাকা, কোনোদিন দেড় হাজার টাকা বিক্রি হয়। দেড়শ থেকে দুইশ টাকা পর্যন্ত আয় করে সে। লাভের টাকা রাতে বাবাকে দিয়ে দেয়। অবশ্য সে ইচ্ছেমতো টাকা দিতে পারে। বাবা কিছু বলেন না।
প্রতিদিন সকালে বিআরটিসি থেকে যাত্রা শুরু হয়। পথে কিছু খেয়ে নেয়। দুপুরের খাবার জুটে মাজারে। রাতের খাবারও। কোনোদিন আমানত শাহ (রহ.), কোনো দিন গরিবুল্লাহ শাহ (রহ.), কোনো দিন মিসকিন শাহ বা বা বদনা শাহ’র মাজারে তাদের খাওয়া হয়।
মাজারে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বিআরটিসির বাসায়। সেখানে ততক্ষণে চলে আসেন তাদের বাবা মাসুম। মাসুুমের খাওয়ার সংস্থানও চলে একইভাবে। কখনো মাজারে পিতা-পুত্রের দেখা হয়। কোনোদিন দেখা হয় হোটেলে। তখন তিনজনে মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করে।
তাদের খাবার পাওয়ার বিষয়টাও অভিনব। বিভিন্ন ব্যক্তি মাজারের সামনে বসে থাকা ভিক্ষুকদের খাবার দেওয়ার জন্য স্থানীয় হোটেলগুলোর প্রবর্তিত বিশেষ কার্ড কিনে দেয়। ৬০/৭০ টাকায় দেওয়া হয় একটি কার্ড। এই একটি কার্ড মানে এক বেলার খাবার। এই ধরনের একটি কার্ডে ভাতের সাথে মাছ বা মুরগি থাকে। কোনো কোনো দিন থাকে সবজি। ভিক্ষুকেরা একাধিক কার্ড পায়। নিজের জন্য একটি রেখে বাকি কার্ড বিশ টাকা করে বিক্রি করে দেয়।
মাসুম, মামুন ও সোহাগদের মতো লোকেরা এসব কার্ড কিনে নেয়। ওই কার্ড নিয়ে হোটেলে গেলে নির্দিষ্ট খাবার দেওয়া হয়। মামুন একটি কার্ড কিনে ছোট ভাইয়ের সাথে ভাগ করে খায়। এক কার্ডের খাবারে তাদের দুজনের পেট ভরে যায়। ভাত খাওয়ার পর তারা আবারও রাস্তায় নামে।