পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা করবে সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি

২২ বছর মেয়াদি চুক্তি, সংযোজন করা হবে নতুন প্রযুক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে কন্টেনার পরিবহনে আসবে গতি

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পথে কন্টেনার পরিবহনের মাধ্যমে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে গতিশীলতা তৈরি, ঢাকা ও সন্নিহিত অঞ্চলের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি বন্দরের সুবিধা সহজীকরণ এবং সর্বোপুরি চট্টগ্রামঢাকা মহাসড়কের ওপর কন্টেনার পরিবহনের চাপ কমাতে নির্মাণ করা হয়েছিল পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা এবং উদ্যোগের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রুটে গত এক যুগেও সফলতার মুখ দেখেনি চট্টগ্রাম বন্দর। অবশেষে সেই স্বপ্নের পানগাঁও টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব অভ্যন্তরীণ লজিস্টিকসে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডলগ’কে প্রদান করা হয়েছে। গতকাল ঢাকায় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। মেডলগের সাথে চুক্তির ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে কন্টেনার পরিবহনে নতুন গতি আসবে বলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে বহুমুখী সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বিআইডব্লিউটিএর মালিকানাধীন ৫৫ একর জায়গার উপর নির্মিত এই কন্টেনার টার্মিনালে বন্দর কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে বেশ কিছু ইকুইপমেন্ট সংযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল যে, এই টার্মিনাল ঢাকা অঞ্চলের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হবে। যা দেশের শিল্প বাণিজ্য অর্থনীতি এবং বিশেষ করে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর পণ্যবাহী গাড়ির চাপ কমাবে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যে পরিমান কন্টেনার আমদানিরপ্তানি হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশই ঢাকা এবং সন্নিহিত অঞ্চলের। এসব কন্টেনারের খুব সামান্যই কমলাপুর আইসিডির মাধ্যমে রেলপথে আনা নেয়া করা হলেও বেশিরভাগই পরিবাহিত হয় সড়কপথে। ঢাকা অঞ্চলের কন্টেনারগুলো নৌপথে চট্টগ্রামে আনা নেয়া করা গেলে খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি বহুমুখি সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবেএমন একটি আশা থেকেই নির্মিত হয়েছিল পানগাঁও কন্টেনার টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই টার্মিনালে নিয়মিত কন্টেনার আনা নেয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত ঢাকা অঞ্চলের যেসব কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে সেগুলো ছোট আকৃতির জাহাজে বোঝাই করে পানগাঁও টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হবে।

অপরদিকে ঢাকা অঞ্চলের রপ্তানিপণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো পানগাঁও থেকে ফিরতি জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। এখান থেকেই ফিডার ভ্যাসেলে ওই কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্টে পোর্টে চলে যাবে। এতে ঢাকা অঞ্চলের কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে আনা নেওয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থায় মহাসড়ক এবং রেলওয়ের উপর যে চাপ পড়ে তা কমে যাবে। একই সাথে ব্যবসায়ীদের খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে।

কিন্তু এতো আয়োজনের পরও গত ১২ বছরেও পাঁনগাও কন্টেনার টার্মিনাল গতি পায়নি। এই টার্মিনালের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার পরিবহনের জন্য বিভিন্ন কোম্পনিকে জাহাজ পরিচালনার অনুমোদনও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তিনটি পুরাতন কন্টেনার জাহাজ কিনে রুটটি সচল করার উদ্যোগ নিলেও তা ভেস্তে যায়। বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি জাহাজের একটি ডুবে গেছে। অপর দুইটি একটি বেসরকারি কোম্পানিকে পরিচালনার জন্য ভাড়া দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এই রুটে চলাচলের জন্য বেশ কয়েকটি জাহাজ থাকলেও পর্যাপ্ত কন্টেনারের অভাবে কখনো এক সপ্তাহে কখনো বা ১৫দিনে একটি জাহাজ কন্টেনার নিয়ে আসা যাওয়া করে। চট্টগ্রামপানগাঁও রুটে কন্টেনার পরিবহন প্রত্যাশিত গতিতে না আসার জন্য অতিরিক্ত ভাড়াই দায়ী বলেও ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেছিলেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে ভাড়াও কমিয়েছিল। কিন্তু এতো কিছুর পর ১ লাখ ১০ হাজার টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষম পানগাঁও টার্মিনালে বিশ থেকে ৩০ হাজার কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল। কোন কোন বছর তা নেমে এসেছিল ৫ হাজারের নিচে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেনার টার্মিনাল (পিআইটিসি) পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি অপারেটরের হাতে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই গতকাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডলগ কোম্পানির সাথে একটি কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গতকাল বিকেলে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ২২ বছর মেয়াদি এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এবং মেডলগ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম আনিসুল মিল্লাত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) . এম সাখাওয়াত হোসেন।

অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, বন্দর ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে আজ একটি স্মরণীয় দিন। ঢাকামাওয়াভাঙ্গা এঙপ্রেসওয়ে থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ঢাকার কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত চুক্তিটি বাংলাদেশের লজিস্টিক ও বাণিজ্য অবকাঠামো উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। এটির মূল সুফলভোগী হবে মূলত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যারা একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। আজকের এই বিনিয়োগ আমাদের স্বপ্নবান তরুণ প্রজন্মের জন্য। বাংলাদেশের লজিস্টিক খাতের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে মেডলগ টার্মিনাল চুক্তি।

উপদেষ্টা আরও বলেন, মেডলগের বিশ্বব্যাপী দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এবং আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবো এবং অভ্যন্তরীণ লজিস্টিকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের শীর্ষস্থানে নিয়ে যেতে পারবো।

চুক্তি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, নতুন চুক্তির আওতায়, মেডলগ এসএ তাদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেডলগ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেনার টার্মিনালের কার্যক্রম, সরবরাহ ও অটোমেশন তত্ত্বাবধান করবে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ লজিস্টিঙকে বিশ্বমানের করা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বৈশ্বিক দক্ষতা ও উন্নত প্রযুক্তি এই টার্মিনালে নিয়ে আসবে। বন্দর সচিব বলেন, এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যে সহায়তা দেওয়ার জন্য মেডলগ পানগাঁও টার্মিনালে নতুন নতুন সুবিধা সন্নিবেশিত করবে। এই টার্মিনালের বার্ষিক হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ১ লাখ ৬০ হাজার টিইইউএসে উন্নীত করবে। মাল্টিমোডাল সংযোগ জোরদার করার লক্ষ্যে পানগাঁওকে অন্যান্য নৌবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে মেডলগ অভ্যন্তরীণ বার্জ ভাড়া করবে বলে উল্লেখ করে বন্দর সচিব জানান, বার্জগুলো বৃহৎ আকারের পণ্যও পরিবহন করবে এবং অন্যদিকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও রিফার যানবাহন অঞ্চলজুড়ে অতিরিক্ত সরবরাহ চ্যানেল খুলবে। উন্নত আন্তঃমোডাল পরিবহন অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা কমাবে এবং লিড টাইম নিশ্চিত করবে। এরফলে স্থানীয় আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধরণের সুবিধা নিশ্চিত হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেনার টার্মিনালের সরঞ্জাম ও সুবিধার মধ্যে দুটি মোবাইল হারবার ক্রেন, রিফার কানেকশন এবং ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি একটি খালি কন্টেনার স্টোরেজ, মেরামত ইয়ার্ড এবং স্টাফিং ও স্ট্রিপিংয়ের জন্য ১০ হাজার বর্গমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত কন্টেনার ফ্রেইট স্টেশন। টার্মিনালসংলগ্ন জমিতে তুলা গুদামজাতকরণ এবং ড্রাই স্টোরেজ ডিস্ট্রিবিউশনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্দর নিয়ে সরকারকে হুঁশিয়ারি জামায়াতের
পরবর্তী নিবন্ধপেঁয়াজের বিপুল সরবরাহ, কমছে দাম