‘তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’ (শামসুর রাহমান)
স্বাধীনতা এসেছে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে। দানবের মতো শহর প্রদক্ষিণ করে বেড়ানো জলপাই রঙের ট্যাংক বিদায় নিয়েছে সেই তখনই। তবে সাকিনা বিবিদের কপাল আজও ভাঙছে, পুড়ছে। সিঁথিতে লেপটানো সিঁদুর নিয়ে হরিদাসীদের মাতমের ছবি খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। ওদের অবুঝ শিশুরা হামাগুড়ি দেয় পিতার লাশের ওপর। বেঁচে থাকা জনতা নির্বিকার; পাথর চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে, আগামীকালের জন্য স্বপ্ন সাজায়।
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা ইউনিয়নের হাসিনাপাড়ার বাসিন্দা মৃণালিনী সুশীলের সিঁথির সিঁদুর মুছে গিয়েছিল প্রকৃতির নিয়মে। ভবিতব্যকে তিনি মেনেই নিয়েছিলেন। সাত সাতটি নওজোয়ান পুত্র তাঁর। আর দুই কন্যা। পুত্রবধু, জামাতা, নাতিনাতনিতে ভরাসংসার মানুরানীর। পুত্রকন্যারা পিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে পরম শ্রদ্ধায়। ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে কোন ত্রুটি রাখে না। প্রভাতের আলো ফোটার সেই পবিত্র প্রহরে মন্দির থেকে বাড়ির পথ ধরে। পিকআপ নামের দ্রুতগামী যান সড়কের পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শোকাতুর ভাইবোনদেরকে চাপা দিয়ে যায় পোকামাকড়ের মতো। চারটি ভাই ঘটনাস্থলেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। হাসপাতালে নেওয়ার পর পঞ্চমও অনুগামী হয়। ষষ্ঠ অচেতন হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বোন দুটির একটি হাসপাতালে শুয়ে আছে পা হারিয়ে, অন্যটি বাড়িতে মায়ের পাশে।
মানুরানী পাঁচ পুত্রকে শেষ বিদায় জানাবেন, না কি স্র কাছে গিয়ে বসে প্রার্থনা করবেন? নাকি স্থানীয় হাসপাতালে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া কন্যার পাশে দাঁড়াবেন? একেকটি পুত্র তাঁর সাত রাজার ধন। কন্যারা চোখের মণি। ওদেরকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য কি যুদ্ধটাই না করতে হয়েছিল তাঁকে! এই পৃথিবী কি সবই ভুলে গেছে! চোখের সামনে পাঁচ তরুণী পুত্রবধু সেজে আছে সাদা শাড়িতে, ঘষে ঘষে মুছে ফেলা হয়েছে ওদের সিঁথির সিঁদুর, ভেঙে ফেলা হয়েছে হাতের শাঁখা। ওদের শিশুপুত্ররা মাথামুণ্ডন করে, ধুতি গামছা জড়িয়ে আশৌচ পালন করছে। পুরোহিতের বাতলে দেওয়া মন্ত্রপাঠ করে শ্রাদ্ধশান্তি করে শোধ করছে পুত্রদায়। এক মাস বয়সী পুত্রটি জানতেও পাওে না সে কি হারিয়েছে।
গণমাধ্যম সব দৃশ্যই ধারণ করে জনতার সামনে উপস্থাপন করছে। আমরা কি সত্যি কিছু দেখছি? আমাদের আত্মায়, আমাদের প্রাণে তার কোনও ছাপ কি দেখা যাচ্ছে? আমাদেরতো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে না! বসন্ত উৎসবে রঙের মেলার কমতিতো হয়নি কোথাও! ডুলাহাজরার মানুরানী বুকে পাথর চেপে প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্রদের শ্রাদ্ধশান্তির দেখভাল করছেন। পুত্রদের পারলৌকিক কল্যাণের জন্য অতিথি আপ্যায়নে কোন ফাঁক রাখতে চাননা মা। আমরা ভুলে গেলেও মাতৃশক্তির এই কঠিন রূপ পৃথিবীকে চিরকাল মনে রাখতে হবে।
ডুলাহাজরা থেকে কিছুক্ষণের চোখ ফেরানো যাক দেশের বাদবাকি জনপদে। কোভিডের প্রতিষেধক সম্পন্ন করে মনের আনন্দে বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল এক কিশোরী রিকশায় চড়ে। দ্রুতগামী যান মুহূর্তেই মুছে দেয় তার মুখের হাসি, নিভিয়ে দেয় জীবনপ্রদীপ। ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের হাইদচকিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিশু আকতার ও নিশা মণি স্কুলে ‘এসাইনমেণ্ট’ জমা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে দিশা হারায় চাঁদের গাড়ি। অন্ধের মতোই মিশু ও নিশামণিকে চাপা দিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় চোখের পলকে। কেন পুলিশ তাড়া দিল, কেনইবা গাড়িটি দিগ্িবদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে পালাতে গেল সে এক বড় প্রশ্ন।
এই শেষ নয়। গৌরনদীতে সড়কে প্রাণ গেল কলেজছাত্রের, পুলিশ কনস্টেবলসহ আহত। সাতক্ষীরায় ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের মৃত্যু। শ্রীপুরে সড়কে ঝরল নানি-নাতির প্রাণ। রাজধানীতে পিকআপ ভ্যানের চাপায় শিশু নিহত। জয়পুরহাটে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ছিটকে সড়কে, ট্রাক পিষে দিল লায়লাকে। রাজবাড়ীতে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপায় যুবক নিহত। নোয়াখালীতে বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল মোটরসাইকেল আরোহীর। দিনাজপুরে বাস উল্টে দুই যাত্রী নিহত। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে সিএনজি আর লেগুনার সংঘর্ষে নিহত প্রকৌশলী পাপন বড়ুয়া। চট্টগ্রাম শহরের বিলাসবহুল রেডিসন ব্লু হোটেলের সামনে অটোরিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে মৃত্যুবরণ করেন চিকিৎসক সামিনা আকতার। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় সাতমাস বয়সী শিশুর মৃত্যু, পা হারালেন মা। এক মাস, বা এক সপ্তাহ নয়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার হালনাগাদ তথ্য। তবে সব খবর পাঠকের চোখে পড়ে না। আর খবরের অন্তরালেও থাকে অনেক খবর।
ঠিক যেন মড়ক লেগেছে সড়কে। বৈশ্বিক মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানবজাতির জয় আসন্ন। সড়কে প্রাণহানির এই মহামারীর শেষ কোথায়? আর কত প্রাণ সড়কে ঝরে পড়লে আমাদের বোধোদয় হবে? এতকাল ঘাতক হিসেবে ট্রাকের নামই শোনা যেত। এখন পিকআপ, ভ্যানগাড়ি, চাঁদের গাড়ি, লেগুনা, টেম্পু, সিএনজি, মাহিন্দ্র, নসিমন, করিমন সকল যানই মানুষ চাপা দিতে পারদর্শী। বিচিত্র নামের এসব যানবাহনের চালকরাই কি প্রকৃত ঘাতক? চালকদেরকে ধরে বেঁধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেই কি নিরাপদ সড়ক পেয়ে যাব আমরা? অজ্ঞ, অশিক্ষিত, অদক্ষ চালকদের হাতে গাড়ির চাবি যায় কি করে, সে প্রশ্ন কি আমরা আজও তুলবো না? চালকের আসনে বসে চাকা ঘোরাতে জানলেই গাড়ির চাবি হাতে ধরিয়ে দেওয়ার এই প্রথা কে বন্ধ করবে? মেয়াদোত্তীর্ন যানবাহন নিয়তই চলছে সড়ক জুড়ে। দেখেও দেখছেনা কেউ। সড়ক আইন সংশোধন নিয়ে কত কথা! কত লেখা! বদলায়না কিছু।
দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, কদাচিৎ, কালেভদ্রে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সড়কে প্রাণহানি ও অঙ্গহানিকে দুর্ঘটনা বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? আবার সকল ঘটনা সমান গুরুত্ব পায় না গণমাধ্যমে। কোন ঘটনা কখনও বিশেষ গুরুত্ব পেলে কর্তৃপক্ষ একটু নড়েচড়ে বসে। তদন্ত করতে গিয়ে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু না, কোন মীমাংসা না করেই থলের বেড়ালকে আবার থলেতে পুরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। অতঃপর অতি দ্রুতই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে দেশকাঁপানো সেই সংবাদ। আমরা দ্রুতই সব ভুলে যাই, যেমন করে ভুলে ঘিয়েছি গেল মাসে ঢাকার মাতুয়াইলে একসঙ্গে মা বাবা ও নানাকে হারানো শিশু সাকিরা আক্তার মিষ্টির কথা। আমরা পাথর হৃদয়ের মানব সন্তানেরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাই সকল বীভৎসতায়। কিন্তু যার যায় সে বা তারা যুদ্ধ করে যায় ভাঙা মন আর ভাঙা কপাল নিয়ে এই নিষ্ঠুর জগত সংসারে। রুপালী পর্দার এক নায়ক সড়কে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানোর পর অনেকটা একাই ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় তিন দশক ধরে। সংকট উত্তরণে তাঁর পরামর্শ আমাদের পথ দেখাতে পারে। তবে তার জন্য চাই কর্তাব্যক্তিগণের সদিচ্ছা।
অতিমারিকালেও কোভিডকে হারিয়ে ঘাতকের তালিকার শীর্ষে সড়ক। মানুরানির পাঁচ পুত্রবধুর অকাল বৈধব্যের স্থিরচিত্রসহ সকল অপমৃত্যুর খবর ক্ষতবিক্ষত করুক পাঠক হৃদয়, জাগিয়ে দিক ঘুমন্ত বিবেককে, প্রাণে কাঁপন ধরিয়ে দিক রথি মহারথীদের। অবসান হোক এই দুঃসহ পাথর সময়ের।
পুনশ্চঃ দেশের সতের কোটি জনতার সকল প্রার্থনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মৃণালিনী সুশীলের ষষ্ঠ পুত্র রক্তিম দু’সপ্তাহ ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে অচেতন হয়ে পড়ে থাকার পর অবশেষে ভাইদের অনুগামী হয়। খবরে প্রকাশ, বছর দুই আগেও মানুরানী এক ছেলেকে হারিয়েছিলেন; হারাধনের আটটি ছেলে, রইল বাকি এক। আবারও তিনি ছেলের শ্রাদ্ধের আয়োজন করেন। গেলবারে একসঙ্গে পাঁচটি শাদা শাড়ি যোগাতে হয়েছিল তাঁকে। এ-যাত্রায় একটা শাদা শাড়ি হলেই চলে তাঁর।