চট্টগ্রাম–নামটা উচ্চারণ করলেই বুকের কোথাও এক উষ্ণ আলো জ্বলে ওঠে। এই শহর শুধু জন্মভূমি নয়, আমার আবেগ, আমার ভাষা, আমার শেকড়। আর এই চট্টগ্রামের ভেতরে, আমার জীবনের সবচেয়ে অমূল্য কোণটির নাম–পাথরঘাটা। সেই সরু গলি, যেখানে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই গলির এক কোণে জীবন জেগে উঠত। মসজিদের আযান আর গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি যেন একসাথে মিশে গিয়ে গড়ে তুলত এক অপার্থিব সকাল। পাশাপাশি থাকা বিশ্বাস, পাশাপাশি বেড়ে ওঠা হৃদয়, আর তাতে লেগে থাকা মায়ার গন্ধ–সেটিই ছিল আমার পাথরঘাটা। আমার প্রিয় স্কুল সেন্ট স্কলাসটিকা ছিল যেন এক মঠসদৃশ আকাশের নিচে স্বপ্নের পাঠশালা। লাল ছাদের সেই পুরনো ভবন, হিমেল করিডোর আর বকুলগন্ধি আঙিনা আজও চোখ বুজলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই সকালে ইউনিফর্ম পরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে চলা, গলির কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা আংকেলের মমতাময় চোখ, আর তার স্নেহভরা কণ্ঠে বলা– “আজও ফার্স্ট হয়ে আসবি তো মা?” আমি হেসে বলতাম, “ফার্স্ট না হলেও তোমার সবচেয়ে আদরেরটা আমি!” সেই গলির ধুলোয় খেলা হতো–ছেলে–মেয়ে মিলে একসাথে, নিঃসংকোচে, নির্মল আনন্দে। লুকোচুরি, গোল্লাছুট, সাজে সাজে খেলা্তসব যেন আজ মনে পড়ে পর্দার মত করেই। সেই মেয়েরা ছিল আমার অমূল্য বান্ধবী, কারো হাসিতে লেগে থাকত কাচের মত স্বচ্ছ আনন্দ, আবার কারো চোখে থাকত চুপিচুপি ভেসে ওঠা কোনো না বলা গল্প। বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতে আমরা ছুটে যেতাম বারান্দায়, তপ্ত রোদের গায়ে ভিজে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে আমরা হেসে গড়াগড়ি খেতাম। কেউ বৃষ্টিতে ভিজে পাখির মতো কাঁপত, কেউ ছাদে গিয়ে দুলে উঠত,
আর কেউ হয়তো চুপিচুপি আমার হাত ধরে বলত, “চলো, একদিন আমাদের এই মুহূর্তগুলো নিয়ে একটা গল্প লিখি।” আমরা জানতাম না, সময় এমন অস্থির হবে। জানতাম না, এদের কেউ কেউ হারিয়ে যাবে জীবনের ভিড়ে, আবার কেউ কেউ থেকে যাবে শুধু পুরনো ছবির এলবামে। আমার সবচেয়ে মায়াময় স্মৃতিগুলোর একটি–গীর্জার ঘণ্টা বাজা। সন্ধে নামলে দূর থেকে সেই মন্দ্র ধ্বনি বেজে উঠত, সব খেলা থেমে যেত, পাড়ার কোলাহল স্তব্ধ হয়ে যেত, আর আমি তাকিয়ে থাকতাম তার দিক্তেসেই বন্ধু, যার চোখে গীর্জার আওয়াজে এক ধরনের শান্তি ফুটে উঠত। আমরা দু’জনেই কিছু বলতাম না। তবে মনে মনে বলতাম, “এই ঘণ্টার মতোই আমাদের দিনগুলো বাজুক, ধীরে, গভীরে, মায়াভরে।” আজ, এইসব মুহূর্তের পাশে দাঁড়িয়ে দেখি–আমার আংকেল আন্টিরা কেউ আর সেই আগের মতো নেই। কেউ দূরে, কেউ আকাশের তারা হয়ে গেছেন। তবে তাদের আদর, সেই চোখে–মায়া–মাখা হাসি, এখনো আমার প্রতিদিনের সাহস। এখনো কোনো বিশেষ দিনে মনে হয়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ ডাকছেন, “ভালো থাকিস মা। সময় গেলেও এই পাথরঘাটা তোকে ভোলে না।” স্কুল, বন্ধু, খেলাধুলা, আংকেলদের কণ্ঠস্বর, আর সেই নির্দ্বিধা শৈশব–সব মিলিয়ে যে ছবিটি গড়ে ওঠে, তাই আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পেইন্টিং। একটি পেইন্টিং, যা প্রতিটি বৃষ্টির দিনে, প্রতিটি পুরনো ঘণ্টার শব্দে, নতুন করে রঙিন হয়ে ওঠে। আজ যখন চারপাশে জীবন অনেক কঠিন, ছুটে চলা ক্লান্তিকর, তখন হঠাৎ গন্ধে, সুরে কিংবা কারো শব্দে,
আমি আবার ফিরে যাই–পাথরঘাটার সেই সরু গলিতে, সেন্ট স্কলাসটিকার বারান্দায়, বান্ধবীদের হাসির সুরে, আর সেই ঘণ্টাধ্বনির তালে তালে বাজা শৈশবের সুরভিতে।