পাঠাগার হচ্ছে জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। দেশ, সমাজ, জাতি–সমপ্রদায়কে শিক্ষা ও সংস্কৃতিজ্ঞানে এগিয়ে নিতে হলে পাঠাগারের বিকল্প নেই। নগর, শহর, বন্দর, মফস্বলে দেশের আনাচে–কানাচে শিক্ষা–সংস্কৃতি, উন্নত রুচিবোধের সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে পাঠাগার একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। মানুষের দৈনন্দিন চিন্তা–চেতনার সাথে নিবিড় মনোসংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে পাঠাগারের ভূমিকা অপরিসীম। পাঠাগারের মুখ নেই, কথা বলতে পারেনা কিন্তু পাঠাগারে রক্ষিত মূল্যবান বই থেকে যে জ্ঞান আহরণ করা হয় তা বিশ্বকে আলোকিত করে। জীবনকে করে তুলে বৈচিত্র্যময়। চিন্তাশীল পাঠকের জন্য পাঠাগার হচ্ছে পরম বন্ধু। নব্বই দশকের শেষ সময় থেকে পাঠাগারের সাথে আমার সেতুবন্ধন। মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের পাশের ভবন সরকারি পাবলিক লাইব্রেরিতে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটতো। নানা বিষয়ের বই, পত্রিকা ও সাপ্তাহিক–পাক্ষিক ম্যাগাজিন পড়তাম। সেখান থেকে মূলত আমার লেখালেখি জগতের সূচনা। তাই পাঠাগারের নামটি শুনলে নিজের মনের ভিতর একধরনের নস্টালজিয়া কাজ করে। সমপ্রতি প্রাক্তন লায়ন জেলা গভর্নর, কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেডের অন্যতম কর্নধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়ার অর্থানুকূল্যে বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ চট্টগ্রাম অঞ্চলের জামালখানস্থ গীতাঞ্জলি ভবনের স্থায়ী অফিসে ‘অনিরূদ্ধ বড়ুয়া অনি স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন করে তাঁর প্রগতি চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। তিনি নিজগ্রাম মহামুনি পাহাড়তলিতেও সন্তানের নামে পাঠাগার স্থাপন করেছেন। অকাল প্রয়াত সন্তান অনিরূদ্ধকে মানুষের অন্তরে সদা জাগ্রত রাখার প্রত্যয়ে দেশের রাষ্ট্রিয়, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে স্থাপনা নির্মাণের মধ্যে দিয়ে নানাভাবে কাজ করে চলেছেন। অনিরূদ্ধ ১৯৯৯ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রয়াত হন।
প্রায় তিন দশক ধরে লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়াকে দেখছি একজন প্রগতিবাদী চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে। তিনি মনেপ্রাণে সংস্কৃতিকে লালন করেন, শুধু নয় পালন ও ধারণ করেন। তাঁর বাবা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, পাকিস্তান গণপরিষদের নাগরিক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফনিভূষণ বড়ুয়া ও মা তটিনী বড়ুয়ার স্মরণেও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ এবং স্মারক বক্তৃতা প্রচলন করেছেন। আমি যদি বর্তমান সময়ে সমগ্র বাঙালির কথা বলি সেখানে সংস্কৃতির একজন সজ্জন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া সবার উর্ধ্বে স্থান পাবে। তিনি যা ভাবেন শেষ পর্যন্ত করে ছাড়েন। তিনি যেভাবে অকাতরে স্থাপনা নির্মাণ ও মানবিক কল্যাণমূলক কাজ করে চলেছেন পাঠাগার স্থাপনের মধ্যে দিয়ে একজন সৃজনশীল, মননশীল চেতনা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে নতুন দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া কথা নয় কাজকে পছন্দ করেন। যারা কাজ করেন তাদের হাতকে প্রসারিত করার চেষ্টা করেন। সংগঠনের পদ–পদবিতে থেকে যারা বছরে একটি অনুষ্ঠান করে নামের বাহানা দেখান তাদের তুলনায় মাসে যে সব সংগঠন একাধিক সেবামূলক কাজ করেন এ জাতীয় সংগঠনকে খুব ভালোবাসেন বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ তার মধ্যে একটি। এই সংগঠনে সন্তানের নামে পাঠাগার স্থাপন করে সৃষ্টিশীলতার যে নব প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে পাঠক সমাজকে উপকৃত করবে। বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের প্রাচীনতম যুব সংগঠন। যেটি ১৯৬৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গত ৩০ নভেম্বর সংগঠনের ৫৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জমকালো আয়োজনে কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও পাঠাগারের শুভ উদ্বোধন করেন প্রাক্তন লায়ন জেলা গভর্নর রূপম কিশোর বড়ুয়া। দেশে–বিদেশে ইতিমধ্যে ২৯ টিরও অধিক শাখা গঠন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন এই সংগঠন।
দেশব্যাপী এখন পাঠকের আকাল চলছে। পড়ার চেয়েও মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ওপর নবীন–প্রবীণরা অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এটিকে এ ধরনের জটিল আসক্তিও বলা যায়। অখাদ্য–কুখাদ্য কিছু টিকটিক দেখলে অনুমান করা যায় আসলে আমরা কোথায় কোন পরিবেশে বাস করছি। এখন সর্বত্র রুচির দুর্ভিক্ষ, পড়ার প্রতি প্রবল অনীহা। পাঠক বিমুখ এ সময়ে বৌদ্ধ যুব পরিষদের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। হয়তো, পাঠক আবার বইমুখি হবে এ প্রত্যাশাও করতে পারি। পাঠাগারে শিশু সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস–ঐতিহ্য নামে আলাদা আলাদা কর্ণার থাকবে। পাঠাগারে ১০ হাজার বই থাকবে। পাঠকরা নাম নিবন্ধন করে বই ঘরে নিয়ে যেতে পারবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়ার নিয়ম রাখা হয়েছে। বছর শেষে অধিক পড়ুয়া নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা হবে। শিল্পপতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনুরাগী লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়ার আদর্শ চিন্তার অনন্য উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পড়ার প্রতি আগ্রহ জাগাবে। অন্তত সংগঠনের সদস্যদের পরিবার ও সন্তানদের নিয়মিত পাঠাগারে নিয়ে আসুন। তাদেরকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলুন। পাঠাগার হলো জ্ঞান আহরণের এক অফুরন্ত জগত, বই হচ্ছে জ্ঞানের শক্তি।
লেখক, প্রাবন্ধিক, সংবাদ কর্মী












