দৈনিক আজাদীর সাথে আমার যোগাযোগ, আত্মীয়তা কয়েক দশকের। সেই সম্পর্কের শুরু পত্রিকার বয়োজেষ্ট্য সাংবাদিকদের দিয়ে। ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চিরদিনের তরে। কেউ কেউ এখনো আছেন। নতুনেরও আগমন ঘটেছে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আজাদীর পাঠক–প্রিয়তা ও কাটতি এখনো শীর্ষে। সংবাদ পরিবেশনা ছাড়াও পত্রিকাটি নতুন পাঠক, নতুন লেখক সৃষ্টি করার সৃষ্টিশীল–কর্মটি দক্ষতার সাথে করে চলেছে। দৈনিক আজাদীর সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ ১৯৮০ সালে। অনার্স পরীক্ষা শেষে রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি।
এমন সময় বন্দর নগরী থেকে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বের হলো ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, দি ডেইলি লাইফ। চট্টগ্রামের প্রথম অফসেট পত্রিকা। তখন মাঝে মধ্যে সকালের দিকে যেতাম আন্দরকিল্লায় দৈনিক আজাদীর পুরানো বিল্ডিংয়ে। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠতেই হাতের বাঁদিকে একটি বড়সড় টেবিল। সেই–টেবিল ঘিরে বসতেন কয়েক সাংবাদিক। তাদের মধ্যে সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, বার্তা সম্পাদক সাধন কুমার ধর, সহকারী ও সাহিত্য সম্পাদক অরুণ দাশগুপ্ত, বিমলেন্দু বড়ুয়া, শরীফ রাজা, মোহাম্মদ ইউসুফ, কাজী জাফরুল ইসলাম, মাহবুব উল আলম প্রমুখ। এনারা মূলত ডেস্কেই থাকতেন। তাদের সাথে বসা কিংবা বসে কোন বিষয়ে আড্ডায় যোগ দেবার মত বয়স, জ্ঞান কোনটাই তখন হয়নি। এখন বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জ্ঞান– সে খুব যে একটা হয়েছে তেমন দাবি করতে পারিনে। ওই কামরায় এর বাইরে দেখা যেত চিফ রিপোর্টার ওবায়দুল হক, রিপোর্টার নাসিরুল হক, আতাউল হাকিম, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, সমীর ভট্টাচার্যকে। পরে এলেন সিদ্দিক আহমদ, হেলাল উদ্দিন চৌধুরী। এদের মধ্যে ওবায়দুল হক, নাসিরুল হক ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর সাথে প্রায়শ নানা অনুষ্ঠানে নিউজ কভার করতে গিয়ে দেখা হতো। এই কটি নাম দেখেই যে কেউ সহজেই বুঝে উঠতে পারবেন দৈনিক আজাদীর সাংবাদিক–টিম কী ‘শক্তিশালী’ ছিল। প্রায় প্রতি সকালে রিপোর্টার নাসির ভাইয়ের মোটর সাইকেলের পেছনে সওয়ার হয়ে হাজির হতাম দৈনিক আজাদী অফিসে। সামনের কামরা পেরিয়ে ভেতরে যেতেই দেখা যেত স্বল্পভাষী, সুদর্শন এক ব্যক্তিকে। পরে নাম জেনেছিলাম এম এ মালেক। সালাম দিলে তিনি মুখে কিছু না বলে সালাম নেবার ভঙ্গিতে সামান্য মাথা নাড়তেন। ধরে নিয়েছিলাম কিছুটা অহংকারী, ইন্ট্রোভার্ট। হতেই পারে, আফটার অল দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক। তার চাইতেও বড় কথা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেকের ছেলে। মনে আছে ডেইলি লাইফে সে–সময়কার ম্যানেজমেন্টের সাথে তাদের কিছু অযৌক্তিক কার্যকলাপের কারণে আমরা যে কয়েক তরুণ সাংবাদিক ছিলাম তাদের সাথে খুব একটা বনিবনা হচ্ছিল না। এলো চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) নির্বাচন। প্রতিবাদ স্বরূপ আমি ও সহকর্মী নুরুল আলম চৌধুরী ম্যানেজমেন্ট–সমর্থিত প্যানেলের বিপক্ষে গিয়ে ইউনিয়ন–নির্বাচনে যথাক্রমে যুগ্ম সম্পাদক ও সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলাম। দৈনিক আজাদীর গুটি কয়েক সাংবাদিক ছাড়া অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সহ সকল সাংবাদিকদের পূর্ণ সমর্থন পেয়ে অনেক ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে আমাদের প্যানেল থেকে কেবল আমরা দুজন নির্বাচিত হলাম। ইতিমধ্যে আজাদীর সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে অরুণদার সাথে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাঝে মধ্যে সহকর্মী নুরু সহ এনায়েতবাজার বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন ফটোর দোকান, ‘আলোকনের’ পাশে তার বাসায় যেতাম। অরুণদার বাসায় গেছি আর মিষ্টি দিয়ে চা খাইনি তেমন দিনের কথা মনে নেই। আমাদের জন্যে বাড়ির পাশে চায়ের দোকানে মিষ্টি–চায়ের অর্ডার দিয়ে তিনি নিজের জন্যে পান আনতে বলতেন।
২. চুরাশি সালে চাটগাঁ ছাড়লাম। ঢাকায় এসে আবারো সাংবাদিকতা। ছয় বছর পর ১৯৯০ সালে ছাড়লাম দেশ। কিন্তু দৈনিক আজাদীর সাথে শুরু হলো নতুন যোগাযোগ। তার শুরু সহকর্মী ও বন্ধু সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের তাগিদ ও উৎসাহে। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে তিন বছর পাশাপাশি দুটি কামরায় প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) কাজ করেছিলাম। একটা সময় সহকর্মী থেকে অতি কাছের বন্ধু হয়ে গেলাম দুজন। তিনি ছিলেন আমার সিনিয়র– বয়স ও অভিজ্ঞতায়। তিনি বললেন, ‘হল্যান্ড ও ইউরোপ সম্পর্কে লিখুন। ছাপানোর দায়িত্ব আমার।’ তারই উৎসাহে ডাকযোগে লেখা পাঠাতে শুরু করলাম তার কাছে। সে–লেখা ছাপা হতো দৈনিক বাংলায় নিয়মিত। সে সময় তিনি আজাদীতেও লিখতেন। তিনি আজাদীর জন্যেও লেখা পাঠাতে বললেন। শুরু হলো দৈনিক আজাদীর জন্যে লেখা। ডাকযোগে সে–লেখা গিয়ে পৌছাতো ঢাকায় তার কাছে। তিনি সে–লেখা পুনরায় ডাকযোগে প্রফেসর খালেদ সাহেবের কাছে পাঠাতেন। প্রফেসর সাহেবের কাছে আমি ঋণী। তিনি আমার প্রতিটি লেখা গুরুত্বের সাথে আজাদীর ‘উপ–সম্পাদকীয়’ পাতায় ছাপাতেন। একবার দেশে গেলে শুনলাম তিনি অসুস্থ। দেখা করতে গেলাম সিরাজুদ্দৌলা রোডে তার ফ্ল্যাটে। এমন বিনয়ী ব্যক্তি খুব কম দেখেছি এ জীবনে। এতো বড় ব্যক্তিত্ব। অথচ কোন অহং নেই, কোন বাড়ম্বতা নেই। মেয়ে সপ্তর্ষি তখন কয়েক বছরের শিশু। এক দুপুরে সুমনা, সপ্তর্ষি সহ গেলাম তার সাথে দেখা করতে। প্রফেসর সাহেব অসুস্থ। অথচ যখন দেখলেন গরমে–ক্লান্ত সপ্তর্ষি তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন তিনি ভেতরের কামরায় ডেকে নিজেই বিছানা পেতে দিলেন সপ্তর্ষির জন্যে, আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও। খুব বিব্রত বোধ করছিলাম। এমনই ছিলেন প্রফেসর খালেদ সাহেব। এ–কথা ও–কথার ফাঁকে তিনি বললেন, ‘হল্যান্ডে যে বিখ্যাত বাঁধ আছে সেটি সম্পর্কে লিখবেন। আমাদের জানা দরকার।’ লিখবো বলে তাকে কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে কথা রাখতে পারিনি। এখনো ওই বিষয় নিয়ে লেখা হয়ে উঠেনি। প্রতি সামারে ভাবি এবার যাবো, ভালো করে দেখে, জেনে লিখবো। একবার ওদিকটায় গিয়েছিলাম। কিন্তু লেখার মত দেখা হয়ে উঠেনি। আগামীতে লেখার ইচ্ছে রইলো। প্রফেসর খালেদ সাহেবের পর লেখা পাঠাতে লাগলাম অরুণদার কাছে। তিনিও এক সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত হল্যান্ড থেকে পাঠানো লেখাগুলি সহযোগী সম্পাদক কবি রাশেদ রউফের হাত ধরে দিনের আলো দেখে। অত্যন্ত সফল সংগঠক কবি সাংবাদিক রাশেদ রউফের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শৈলী বিদগ্ধ লেখক ছাড়াও নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করে চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনে এক প্রশংসনীয় কাজ করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
৩) দেশে গেলে আজাদী অফিসে বার কয়েক না গেলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না। অফিসে গিয়ে প্রথমে ঢু মারি সম্পাদক এম এ মালেক সাহেবের কামরায়। তার সাথে আগেই ফোনে সময় ঠিক করা থাকে। আশির দশকে প্রথম–দেখা স্বল্পভাষী এম এ মালেক, আর এর বছর কয়েক পর অতি কাছ থেকে দেখা ও চেনা এম এ মালেকের অনেক অমিল ও পার্থক্য চোখে পড়ে। অফিসে তার গুরু–গম্ভীর চেহারার ভেতর লুকিয়ে আছে হাস্যরসে ভরা এক ব্যক্তি। সেটি যত তার সাথে নৈকট্য বাড়ে তত বেশি ধরা পড়ে আমার কাছে। অফিসে তার সামনের টেবিলের পরে একগাদা বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকার স্তূপ। অনেক সময় কামরার বাইরে থেকে তাকে দেখা যায় না। সেদিক লক্ষ্য করে কিছু মন্তব্য করলে মালেক ভাইয়ের স্বভাবসুলভ উইটি উত্তর, এগুলি সামনে রাখি যাতে লোকে মনে করে অনেক পড়াশুনা করি। আসলে তো করিনা।‘ শুরুতে বলেছিলাম দক্ষ সাংবাদিকরা ছিলেন এবং আছেন বলেই আজাদী জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে। কিন্তু এটিও অনস্বীকার্য যে দক্ষ–পরিচালনা ছাড়া আজাদীর পক্ষে আজকের পর্যায়ে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব হতো না। আর এই কাজটি বছরের পর বছর করে চলেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি কেবল একজন দক্ষ পরিচালক নন, সুদক্ষ লেখকও। তার লেখায়, কথায়, বক্তৃতায় যে রসবোধ, যে ‘সেন্স অব হিউমার‘ তা পাঠক, শ্রোতাকে আনন্দ দেয়। চলতি বছরের শুরুতে দেশে গেলে তার কাছ থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া ‘উল্টো থেকে’ বইটি পেয়েছিলাম। দেশে থাকতেই বইটির লেখাগুলি উৎসাহ ভরে পড়েছি। সত্যি বলতে কী এর মধ্যে দিয়ে আমার আর এক নতুন এম এ মালেককে আবিষ্কার। দেশে পৌঁছে যখনই ফোন করে জিজ্ঞাসা করি, ‘মালেক ভাই, ব্যস্ত?’ হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার আবার ব্যস্ত, ব্যস্ততা দেখাই, আসলে ব্যস্ত না।’ কিন্তু আমার মত তাকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন আজাদী তার আর একটি প্রিয় সন্তান। হল্যান্ডে দেখেছি কদিন যেতে না যেতেই আজাদীর জন্যে তিনি কেমন যেন ছটফট করছেন। আমার অফিসে একদিন নিয়ে গিয়েছিলাম ভাবী সহ। ল্যাপটপ খুলে দিতেই তিনি দৈনিক আজাদীর পাতায় গিয়ে মশগুল হয়ে রইলেন। ভাবী বলেন, ‘ও আজাদী অফিসে একদিন না গেলে ছটফট করে। যাবেই, সে যত ব্যস্ত থাকুক আর যত রাত হোক।’
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে জানতে চান, এই পত্রিকার বৈশিষ্ট কী! আজাদী যেমন সংবাদ ছাপায়, অন্যান্য পত্রিকাও তো সংবাদ ছাপায়। উত্তরে বলি, আজাদী পাঠকের ‘পালস’ বুঝতে পারে। মালেক ভাই একবার বলেছিলেন, ‘কোন সংবাদকে আমরা অবজ্ঞা করি না। কেউ যখন কোন সংবাদ পত্রিকা অফিসে পাঠান তখন উনি বা ওনারা আশা করেন সংবাদটি পরদিন না হয় দু–একদিন বাদে ছাপা হবে।’ পাঠকের সাথে পত্রিকার যোগসূত্রের এটিও অন্যতম কারণ। একবার পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘মনে করবেন এটি আপনার পত্রিকা। যখন ইচ্ছে করে চলে আসবেন।’ বিনয়ের শেষ নেই যেন। দৈনিক আজাদীর মালিক ‘মালেক পরিবার‘ বটে, কিন্তু সাংবাদিক, লেখক, পাঠকরাও এর পরোক্ষ মালিক। পাঠক পত্রিকার সাথে একাত্মতা বোধ করে বলেই তো আজাদী সবার–আজাদীতে পরিণত হয়েছে। মোদ্দা কথা, ‘আজাদী ক্যান রিড দ্য পালস অব দ্য রিডার্স।’ কথাটা সত্যি। পাঠক কী চায় সেটি বুঝতে সক্ষম বলেই দৈনিক আজাদী আর সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে, এখনো মাথা উঁচু করে আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। দৈনিক আজাদীর জন্মদিনে অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।