আনসার আলী কোরেশী– আমার ভাই, আমার বন্ধু। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৬০ সালে আমি তখন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ছাত্র। সেই সময় বাংলা ভাষার অধ্যাপক হয়ে আসলেন আমার অতি প্রিয় অধ্যাপক জনাব মমতাজউদদীন আহমদ। এসে উঠলেন লাভলেইনে, কোরেশী সাহেবের বাসায়। অনেকে জানেন মমতাজউদদী্লন স্যার একজন নাট্যব্যক্তিত্ব। তিনি কোরেশীদের সঙ্গে থাকতেন বলেই– কোরেশী এবং শাহাজাহানের সঙ্গে আমার পরিচয়। কোরেশী সাহেবের সঙ্গে আমার সাফ বক্তব্য ছিল– পাবনায় পাগলা গারদ মানে পাবনায় পাগল বেশি। উনি কিছুতেই এটা মানতে রাজি নন। বললেন, সরকারের ইচ্ছাতেই সেখানে হয়েছে। আমিও তা মানতে রাজি নই। জনাব কোরেশী পাবনার বনেদী ঘরের সন্তান। তার বাবা জনাব আবদুল হামিদ তৎকালে এমএলএ ও এমসিএ ছিলেন পাবনা শহরে। পাবনার মূল সড়কের নামও উনার বাবার নামে ‘আবদুল হামিদ সড়ক’। কোরেশী সাহেব চট্টগ্রাম এসেছিলেন চাকরির সুবাদে। উনার ভগ্নিপতি ইসকান্দর আমিরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল জুবিলি রোডে। নাম ‘রোক্সানা ট্রেডার্স। তাদের মূল ব্যবসা ছিল Lucas Battary. আমেরিকান ওষুধ কোম্পানি Eli Lilly and Company–র সাথেও তাদের সম্পর্ক ছিল। ইসকান্দর আলি সম্পর্কে একটু লিখতে চাই। তিনি খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। ষাটের দশকে কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার পর সেখানে বিরাট লেক বা হ্রদের সৃষ্টি হয়। উনি চাটগাঁ এলে সময় পেলেই সেই লেকে চলে যেতেন। সেখানে Skiing করতে ভালোবাসতেন। তাঁকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে আমাকে উৎসাহিত করে কাপ্তাই নিয়ে গিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, অনেক চেষ্টা করেও সেই স্কীর ওপর উঠা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কয়েকদিন চেষ্টার পর মজার ‘স্কী’ বাদ দিয়ে দিলাম।
সেই সময় ঢাকায় হাটখোলা রোডের মাথায় যে US Library ছিল তার মালিকও ছিলেন তিনি। প্রথম দিকে লুকাস ব্যাটারির এজেন্সি দিয়ে আরম্ভ করলেও পরে তিনি বায়েজিদে কারখানা করেন। সেখানে তৈরি হতো Oldham ব্যাটারি। দাম ছিল ৩০০ টাকা। এখনকার মত এই ব্যাটারির কোনো ওয়ারেন্টি গ্যারান্টি ছিল না। পানিটা ঠিক রাখলে আর নিয়মিত সার্ভিসিং করলে ২/৩ বছর চলে যেত। বর্তমানে ব্যাটারির দাম ৬/৭ হাজার টাকা। কিন্তু এগুলো এক বছরের বেশি চলে না। সেই ৬০ এর দশকে গেলাম কোরেশী সাহেবের বাড়িতে, পাবনায়। এখানে বলে রাখি, পাবনা রসকদমের জন্যও বিখ্যাত। রসকদম এক ধরনের মিষ্টি। পাবনা শহর দেখে এক সময় পাগলা গারদ দেখতে গেলাম। এই পাগলা গারদ কিন্তু বদ্ধপাগলদের জন্যে নয়। যাদের ভালো হওয়ার আশা আছে, সম্ভাবনা আছে তাদেরই এখানে রাখা হয়।
গারদ কর্তৃপক্ষ আমাদের যথেষ্ট খাতির করলেন– যখন শুনলেন আমি পত্রিকার সঙ্গেও জড়িত। আমাদের একজন গাইড দেয়া হলো। তিনি আমাদের পুরো গারদ দেখাতে লাগলেন। সেই সাথে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কে কোন ধরনের পাগল। অনেক আগের ঘটনা বলে স্মৃতি থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবে এক মহিলার কথা মনে আছে। মধ্যবয়সী মহিলা, বেশ হাসিখুশি। গাইড জানালেন, উনি এখানে আছেন কয়েক মাস। ঘটনায় জানলাম উনি আসলে পাগল নন, পাগলের অভিনয় করেছিলেন। প্রসঙ্গত, এই পাগলা গারদে যারা থাকেন তাদের ভরণপোষণ দিয়ে থাকতে হয়। উনিও তাই আছেন। উনার সমস্যা– উনি বন্ধ্যা। অর্থাৎ ছেলেপুলে হবে না। যেহেতু ছেলেপুলে হবে না তাই স্বামী আরেক বিয়ে করবেন। আর উনি ঠিক করেছেন সতীনের ঘর করবেন না। তাই পাগলের অভিনয় আরম্ভ করলেন। একদিকে তাকিয়ে থাকেন। কতক্ষণ হাসেন, কতক্ষণ কাঁদেন। একবেলা খান তো অন্য বেলায় খান না। ডাক্তার ডাকা হলো। দেখেশুনে বললেন– ঘাবড়াবার কিছু নেই, পাবনায় পাঠিয়ে দেন। কয়েকটা শক ও থেরাপি পেলে ভাল হয়ে যাবে। অগত্যা তাকেও পাবনায় আসতে হয়।
এ সবই আমার গাইড আমাকে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। যখন গারদ দেখা শেষ হলো তিনি আমাকে বললেন, ভাই আপনার সঙ্গে একটু একান্তে কথা আছে। একটু এদিকে আসতে পারবেন। বললাম, নিশ্চয়ই। গেলাম একদিকে। অন্যদের থেকে একটু দূরে। গাইড বললেন, শুনেছি আপনি সাংবাদিক। আপনি চাইলে আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন। বললাম, সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই করব।
বললেন, আপনি সাহায্য করলে আমার উপকার হয়। বললাম, বলুন আপনার জন্যে কি করতে পারি? এরপর গাইড যা বললেন তা হল– ‘আসলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেব নন। আসল প্রেসিডেন্ট হলাম আমি। আইয়ুব খান তা বুঝতে পেরে আমাকে পাগল বানিয়ে এখানে এনে বন্দি করে রেখেছেন।’ অতঃপর তিনি পাগলা গারদ থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমার সাহায্য চাইলেন। বললেন, ‘আইয়ুব খানের জায়গাত বইত পাইরল্যে অনরেও মন্ত্রী বানাই দিয়ুম।’ বুঝলাম উনিও চাটগাঁইয়া।
বি: দ্র: ফটিকছড়ির জামালউদ্দিন সাহেবের নাম আপনারা সবাই শুনেছেন। একসময় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। জামালউদ্দিন সাহেব আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। এক সময় উনি রাউজান আসন থেকে আমাকে এমপি নমিনেশন দেয়ার জন্য বাসায় এসে হাজির হয়েছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আর সেবার আমার গাইডকে পাগলা গারদ থেকে বের করতে না পারায় মন্ত্রী হওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।