পাহাড়, সমুদ্র, নদী,জংগল, দৃষ্টি নন্দন সুউচ্চ ভবন, আর অত্যাধুনিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল ও ব্যস্ত জনপদ হংকং। এটি বিশ্বের অন্যতম মুক্ত অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা, বিনিয়োগ ও শিপিং–এর কেন্দ্র। হংকং এ ২৬০এর অধিক দ্বীপ থাকলেও মূলত হংকং আইল্যান্ড, কাউলুন ও নিউ টেরিটোরিজ এই তিনটি দ্বীপের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে মানুষের জীবন যাত্রা। হংকং দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলবর্তী একটি অঞ্চল, যা পার্ল নদীর মোহনার কাছে অবস্থিত। প্রাকৃতিকভাবে উৎকৃষ্ট এর বিখ্যাত হংকং বন্দরটি এই সাগরের অংশ। ১১১০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটি আয়তনে আমাদের রাজধানী ঢাকার চেয়ে ছোট। ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা‘ নীতির অধীনে স্বায়ত্তশাসিত হংকং বর্তমানে গণচীনের একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। যদিও চীনের আগ্রাসন নীতি হংকং এর মূল অধিবাসীদের জন্য মর্ম পীড়াদায়ক। মাঝে মাঝে ক্ষোভ উগরে আসে। অনেক হংকংবাসী পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ন দেশে। হংকং আমাদের মতই ব্রিটিশ কলোনি ছিলো একসময়। অঞ্চলটিতে তাই ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। মূল হংকং এর অধিবাসীরা ইংরেজি ও চায়নিজ দুই ভাষাতে কথা বলে। এই দুটি ভাষাই সরকারি ভাষা।
হংকং এ প্রাইভেট পরিবহন নিরুৎসাহিত করা হয়। তাদের সকাল ছয়টা থেকে রাত একটা পর্যন্ত দ্রুতগতির মাস ট্রানজিট রেলওয়ে (ভূ–গর্ভস্থ রেল), ট্রাম, বাস, ক্যাব, ফেরি, শীপ, পায়ে চলার প্রশস্ত ফুটপাত, রাস্তা পারাপারের ডিজিটাল নিয়ম সহজ এবং আশ্চর্য রকমের গতিসম্পন্ন করেছে জীবন যাত্রাকে। বিপুল জনস্রোতের দেশটি যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। নিয়মের নিগড়ে নেই এতোটুকু ছন্দপতন। সর্বত্র কিউ। সর্বত্র ফিতা টেনে, গণ্ডি একে, যত্রতত্র সিড়ি, এস্কেলেটর ও ফুটপাত দিয়ে বিশেষ করে টিকিট কাটার ইলেকট্রনিকস কার্ড বিপুল মানুষের দৈনন্দিন ছুটে চলায় এনেছে আশ্চর্য রকমের স্বস্তি ও শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলা না মানা দেশের মানুষ হয়েও বিষয়টি আমাকে দারুণ মুগ্ধ করেছে।
ধর্ম না মানা লোকের সংখ্যা বেশি হলেও সর্ব ধর্মের লোক এদেশে বাস করে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উৎসবগুলো তাই তারা বেশ জাঁকজমকের সাথে উপভোগ করে থাকে। যেমন বড়দিন, হ্যালোউইন উৎসব, চিনা চান্দ্রবৎস ইত্যাদি। কাউলুনে যেমন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ দেখেছি, তেমনি নজর কেড়েছে গীর্জা। স্থানীয় ও দেশ বিদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মহাতীর্থ বিগ বুদ্ধা। ব্রোঞ্জ এর তৈরি বিশাল বুদ্ধ মূর্তিটি লানতাউ দ্বীপের নং পিং অঞ্চলে সুউচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্থিত একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। নং পিং যাওয়ার পথটিও দারুণ সুন্দর। একদিকে পাহাড় আরেকদিকে সমুদ্র, মাঝখানে পথ এঁকেবেঁকে ক্রমশ উপরে। দশ হাজার বুদ্ধ মূর্তির বর্ণিল কারুকাজ দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রার্থনা ঘরটি। পাহাড়টি ঘিরে অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অসংখ্য রেষ্টুরেন্ট ও স্যুভেনির এর দৃষ্টি নন্দন দোকান ঘর। এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অতি উন্নতির কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বেশি। হাসপাতালগুলো ফাঁকা থাকে। নব্বই, একশ পেরুনো অতিবৃদ্ধ, মৃত্যু পথযাত্রী রুগীরাই কেবল হাসপাতালের বাসিন্দা। আর তাই রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াগুলো সুপরিকল্পিতভাবে গুছানো। রেসিডেন্স কমপ্লেক্স এর মধ্যেই ডাক্তার, হাসপাতাল,স্কুল, মার্কেট, খেলার মাঠ, জীম, পুল, গার্ডেন, ওয়ার্কওয়ে সহ সবধরনের সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান। বিশেষ করে বয়স্কদের সুবিধার্থে।
কাউলুন পার্কে বেড়াতে গেলাম একদিন। সুবিশাল পার্ক। জলাশয়ে ফ্লেমিংগো পাখিদের মেলা। পার্কে বসে বই পড়ছেন, ঝিমুচ্ছেন, দুপুরের লাঞ্চ করছেন কিংবা শরীর চর্চায় ব্যস্ত অতি বয়স্ক সব মানুষ। যারা হুইলচেয়ারে আছেন যাবতীয় সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ বিশেষ চেয়ারটি তারা নিজেরা পরিচালনা করছেন। খুব কম বৃদ্ধ আছেন যাদের সাথে সহায়তাকারী আছেন।
হংকং এ আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং এর অভ্যন্তরীণ ফ্ল্যাট বাড়িগুলো আয়তনে খুবই ছোট। সীমিত জায়গায় অত্যাধুনিক ভাবে বসবাসের জন্য যা প্রয়োজন, তার সবই নান্দনিক ভাবে বর্তমান। আইকিয়া মলে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ছোট পরিসরের গৃহকোণকে কতটা ভালো ও দৃষ্টিনন্দনভাবে ব্যবহার সম্ভব তারই উজ্জ্বল নমুনা।
আমার হংকং থাকাকালীন সময়ে তাইপোর নামক জায়গায় বহুতল আবাসিক কমপ্লেক্সে আগুন লাগলো। সে এক ভয়াবহ ব্যাপার। শুনলাম অতীতে নাকি এমন ঘটনা দেশটিতে আর ঘটেনি। বিল্ডিং কনষ্ট্রাকশন চলাকালীন অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা। বুঝলাম দুষ্টু লোক সর্বত্র।
চারপাশে গাঢ় নীল সমুদ্র ও পাহাড় মাঝখানে ছোট দ্বীপ চেউং চাউ। আকৃতির কারণে দ্বীপটিকে ডাম্বেল আইল্যান্ডও বলা হয়। ঘুরতে গেলাম একদিন সারাদিন। খেলাম সী ফুড আর হাফ সিদ্ধ শাকপাতা ও সবজি। দারুণ মজার স্ন্যাকস খেলাম ম্যাংগো মোচি। পাহাড়ের ধাপে ধাপে সমুদ্র মুখি ঘরবাড়ি। আঁকাবাঁকা পেঁচিয়ে ওঠা সরু পাথুরে রাস্তা ওপরে উঠে গেছে। সাইক্লিং এবং হাইকিং করছেন অনেকে। ইঞ্জিন চালিত গাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁর আধিক্য ভারাক্রান্ত করেনি দ্বীপটিকে। লোকাল বাড়িঘরের সামনে যেমন মনোরম বারান্দা, ফুলবাগান তেমনি হরেক রকমের শুটকি রোদে শুকাচ্ছে। তবে সবটাই এতোটা পরিষ্কার কিছু একটা ফেলতে নিজেরই লজ্জা লাগবে। পাহাড় ও সমুদ্র ঘেরা পুরো দ্বীপটির পরিবেশ দারুণ মনোরম।
জাহাজে করে আসতে আসতে নজর কাড়লো দূরে দূরে সবুজ বনানী ঘেরা ছোট ছোট দ্বীপ। কোথাও কোথাও কাজ চলছে। পর্যটন নির্ভর অঞ্চলটি অদূর ভবিষ্যতে দ্বীপগুলিকে ব্যবহার উপযোগীতে প্রয়াসী হবে অবশ্যই। তবে এখানকার সমুদ্র শান্ত নয়। প্রায় টাইফুন, হারিকেন, অশান্ত বাতাস হংকং বাসীর নিত্যসঙ্গী।
একদিন গেলাম ডিজনি ল্যান্ড। এশিয়ার সেকেন্ড লারজেস্ট ডিজনি ল্যান্ড। ল্যানটাউ দ্বীপের পেনি‘স বে এলাকায় এটি অবস্থিত। সানি বে স্টে হয়ে ডিজনি রিসোর্ট লাইনে গিয়ে যখন মাস ট্রানজিট রেলওয়েটি তে উঠলাম ট্রেনের সাজসজ্জা দেখে আমার মনে পড়ে গেলো বহু বছর আগে শান্তি নিকেতনে যাওয়ার সময় যে ট্রেনটিতে উঠেছিলাম সেই ট্রেনটির কথা। সেটি সজ্জিত ছিলো রবিন্দ্রনাথের আঁকা ছবি ও কবিতা দিয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিলো রবিঠাকুরের গান। এই ট্রেনটিও তেমনি। মনে হলো বুঝি কার্টুনের দুনিয়ায় এসে পড়েছি। ছোট বেলা থেকে যে জেনারেশন কার্টুন দেখে দেখে বেড়ে উঠেছে, ডিজনি ল্যান্ড তাদের জন্য স্বর্গরাজ্য। শিশু থেকে তরুণ সবাই ডিজনির নানা চরিত্রের সাজে সজ্জিত হয়ে এসেছে। চায়নিজ বাচ্চাদের লাগছে বারবি ডল। এখানকার জনপ্রিয় স্লোগান হচ্ছে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জায়গা, জাদুতে বিশ্বাস করুন।’ এতো বিশাল পরিসরের রূপকথার অপরূপ রাজ্য ডিজনিল্যান্ড, একদিনে দেখে শেষ করার নয়। তবে যা দেখলাম তাতেই মন ভরে গেলো। দিন শেষে দারুণ সুন্দর ডিজনি ক্যাসেলের লাইটিং শো ছিলো দেখার মতো।
পর্যটনের অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা বান্ধব হংকং এখন পাশ্চাত্যের লোকেদের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু নব্যধনী চায়নিজদের। একসময়ের সমাজ তান্ত্রিক চীনের পণ্যের বাজার এখন বিশ্বব্যাপী। হাল ফ্যাশনে দুরস্ত নতুন প্রজন্মের চায়নিজ ছেলে মেয়েরা জীবনটাকে এখন অনেক বেশি উপভোগ প্রত্যাশী।
হংকং এ ইণ্ডিয়ার চেয়ে পাকিস্তানিদের সংখ্যা বেশি। কিছু পাকিস্তানি আছে বংশ পরম্পরায়। হংকং এর প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এদের কমিউনিটি, মসজিদ দেখা যায়। বাংলাদেশীদের সংখ্যা কম। তবে বর্তমানে বংলাদেশী শিক্ষার্থীরা বেশ আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা আগে থেকে আছেন, হয়তো এসেছেন চাকরি বা ব্যবসা সূত্রে, তাদের অনেকের অবস্থা বেশ ভালো। অনেকে এসেছেন এসাইলামে। হংকংএ সাতবছর থাকলে ‘পি আর’ (Permanent Residence) পাওয়া যায়। বিষয়টি আগ্রহী করে তুলছে এখন অনেককে। অনেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ করে দেখলাম, চার বছর গ্রেজুয়েশন জীবনের অবসানে, বাকি তিন বছর উচ্চতর ডিগ্রি বা একটা চাকরি নিয়ে তারা ‘পি আর’ পেতে চায়। ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় অদূর ভবিষ্যতে যে এই অঞ্চল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সুযোগ সুবিধায় বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে যাবে তাতে তাদের কোন সন্দেহ নেই। এ ছিলো ২০২৫ এর নভেম্বরে নাশিতার কনভোকেশন উপলক্ষে আমার দশদিনের প্রথম হংকং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ, সাবেক অধ্যক্ষ, মহিলা কলেজ–চট্টগ্রাম।











