পাখিতন

সাদিয়া সুলতানা | শুক্রবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

.

মেয়েটাকে পেছন থেকে একটা চারপেয়ে প্রাণীর মতো দেখা যায়। একটু আগে ও শান্তই ছিল। মেঝেতে দুই পা ছড়িয়ে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। খাচ্ছিল না বলে ছড়াচ্ছিল বলাই ভালো। এমনিতে ভালো করে মুঠোতে কিছু তুলতে পারে না পাখিতন। বৃদ্ধাঙ্গুল বাদে চার আঙুল দিয়ে খামচে টেনে ধরে জিনিসপত্র। তারপর মুখের দিকে সজোরে ছুঁড়ে দেয়। এই মুহূর্তে পাখিতন মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে এমনভাবে দুই পা ভাঁজ করে সামনের দিকে ঠেলছে যে দেখে মনে হচ্ছে এখনই ও কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মনে হতে না হতেই সে ঝপাং করে সখীতনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সখীতন পাকঘরে বসে কুলায় করে চিড়া ঝাড়ছিল আর আড়চোখে উঠানে বসে থাকা পাখিতনকে দেখছিল। মেয়েটাকে এমন নজরে নজরে না রাখলে অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটে যায়। অবশ্য নজরে রাখলেও ঘটে। এখন যেমন ঘটল।

পাখিতন শিকারি বাজের মতো সখীতনকে খামচে ধরে আছে। শুধু ধরে থাকলেও হতো, ক্রমাগত চিৎকার করছে ও। এই চিৎকার জান্তব হলেও এর স্পষ্ট কোনো আওয়াজ নেই। সখীতন চিৎকার করার জন্য হা করতেই পাখিতনের ইস্পাত কঠিন হাত ওর ঠোঁট বরাবর থাপ্পড় বসিয় দেয়। কেন হঠাৎ ও এত আগ্রাসী হলো তা ধরতে পারে না সখীতন।

মামেয়ের যুদ্ধটা কলপাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে দেখে শাজান। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেছে তার। কাজে বের হওয়ার সময় হয়েছে। বিবিকে বলেছিল চিড়া ভিজিয়ে দিতে। এখন চিড়া মাটিতে গড়াচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে পাখিতনের থাবা থেকে বিবিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না শাজান। কয়লা ঘষা দাঁতের ওপরে জিহ্বা চালিয়ে নিয়ে বিকট আওয়াজ করে মাটিতে থুতু ফেলতে থাকে।

.

ঘুমিয়ে থাকলেই ঠান্ডা থাকে পাখিতন। যদিও ও বেশিক্ষণ ঘুমায় না। অন্য কাউকে ঘুমাতেও দেয় না। জেগে উঠে রাজ্যের অনর্থ করে। আজও তাই করছে।

মেয়ের কাণ্ড দেখে স্বামীর বলশালী দেহের ভেতর থেকে পিছলে বেরিয়ে আসে সখীতন। তারপর চৌকির ওপরেই স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। রতিক্রিয়ায় ব্যর্থ শরীরটাকে ঠান্ডা করতে খানিকক্ষণ অশ্রাব্য গালিগালাজ করে শাজান। ওর থুতুভেজা ঠোঁটের ফাঁকে দাপুটে শব্দেরা খাবি খায়। এরপর গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। পাখিতন ততোক্ষণে ঘরের কোনে থাকা মুড়ির ধামা থেকে মুঠো মুঠো মুড়ি নিয়ে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে। এই একটি কাজ ও খুব মনোযোগের সাথে করে। ঘরের মেঝেতে মুড়ি ছড়িয়ে নিয়ে নিবিড় মনোযোগে খুঁটে খুঁটে খায়। কখনও বা এক মুঠ মুড়ি ঠেসে দেয় মুখের ভেতরে, গলায় আটকানোর উপক্রম হলে সখীতন মেয়ের কাছে ছুটে যায়।

আজ আর ছুটে যেতে পারে না ও। শাজান টেনে ধরে। স্থির মানুষটা আবার সখীতনের শরীরটা নিজের দিকে টানতে শুরু করেছে। এবার আর সময় নেয় না শাজান, সখীতন প্রস্তুত হয়ে ওঠার আগেই ক্ষিপ্রগতিতে কাজ সেরে ফেলে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকে। কামিজটা নিচের দিকে নামাতে নামাতে সখীতন মেয়ের দিকে ছুটে যায়।

চল চল, ভাত খাওয়ায় দিই।’

হঠাৎ শাজানের বিষতিতা কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

এত মানুষ মরে, এইটা মরে না।’

বাপের কথা শুনেও কোনো চেতভেদ হয় না পাখিতনের। বরং ও উৎসাহের সাথে ধামা থেকে আরও কয়েক মুঠ মুড়ি তুলে আনে। ওদিকে বাপের মুখের শাপ যদি লেগে যায় সেই চিন্তায় ওর মা সুখীতন পুরো আটরাই গ্রাম কাঁপিয়ে কাঁদতে বসে। বিবির বিলাপ শুনে বিছানায় শুয়ে থাকা শাজান চুলায় বসানো ডালের মতো বলকায়।

.

নখের ভেতর থেকে উকুন বের দুই বৃদ্ধাঙ্গুলির নখে পিষে মারে সখীতন। মাথা ভর্তি উকুন ওর। একদিন গোসল না করলেই উকুনের দল মাথার তালুতে উঠে বড় যন্ত্রণা শুরু করে। গতকাল গোসল করতে পারেনি। মেয়ে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। ওর জিদ উঠে গিয়েছিল বাপের থাপ্পড় খেয়ে। ঐ জিদ নামাতে সখীতনও পালটা জিদ দেখিয়েছে। পাখিতনকে সাধ মিটিয়ে মেরেছে। মায়ের অযাচিত আক্রমনে বিহ্বল হয়ে পাখিতন বাড়াবাড়িও করেছে বেশ।

আজ পাখিতন চুপচাপ আছে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে অস্থির হয়ে সখীতন মেয়েকে ডাকে, ‘পাখিও পাখি…!’ মায়ের ডাক শুনে সাড়া না দিলেও হাতের মুঠোতে আঁকড়ে রাখা মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পাখিতন। ধীর পায়ে মায়ের কাছে আসে। পাখিতনের কাদামাটি মাখা মুখ দেখে অস্থির হয়ে ওঠে সখীতন। কী করে এই অবুঝ শিশুকে নিয়ে! কোথায় যায়!

মেয়েকে রেখে কাজের খোঁজে যাবে সেই উপায় নেই সখীতনের। পাড়াপ্রতিবেশীদের কেউ কেউ পরামর্শ দেয় মেয়েকে শিকলে বেঁধে রাখতে। শুনে প্রথমে আঁতকে ওঠে সখীতন। তারপর পাড়া কাঁপিয়ে কাজিয়া করে। কাজিয়া জমে উঠলে পিছু হটে ঘরের চালিতে বসে কাঁদতে শুরু করে।

গর্ভে সন্তান আসার পর সখীতনকে জিনে ধরেছিল। মোল্লাপাড়ায় ঢোকার মুখে যেই ছাতিম গাছটা আছে একদিন সেটার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা দমকা হাওয়া ছুটে এসেছিল গায়ে। বাড়ি ফেরার পর খিঁচুনি হয়েছিল সখীতনের। জানে সখীতন, সেই থেকেই গর্ভে দোষ লাগল। পাখিতনের জন্মের পর জিন ওকে ছেড়ে পাখিতনের ওপর ভর করল।

হৃদপিণ্ড ধুকপুক করে ওঠে সখীতনের, এই জিন ছাড়াতে না পারলেমেয়ের ভবিষ্যত কী হবে!

.

পাখিতনের বয়স হিসাব করে সখীতন। এই অগ্রহায়নে মেয়ের নয় হবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি মেয়ের এই হাল হলো! মেয়ের দুই উরুর ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া লাল রক্তের ধারা দেখে সখীতনের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কী করবে ও এখন, মেয়েকে কোথায় রাখবে? কোথায় লুকাবে? ধীর পায়ে এসে মেয়ের কম্পনরত দেহটা জাপটে ধরে সখীতন। তারপর পাখিতনের মতোই জান্তব স্বরে কাঁদে। মায়ের কান্নার শব্দে আরও চঞ্চল হয়ে ওঠে পাখিতন। দুই হাত দিয়ে মায়ের আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে পানি ভরা বালতির ভেতরে নিজের মাথা ডুবিয়ে দেয়।

কলপাড়ের কাছে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা শাজান চিৎকার করে ওঠে, ‘ঐটারে পানিতে ডুবায়া মাইরা ফ্যালো!’

মুহূর্তের জন্য সখীতনের মনে হয় ওর হৃদপিণ্ডটা কেউ যেন একটা ভারি শিল তুলে থেঁতলে দিয়েছে। বাতাসের অভাবে ওর মুখ চোখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। দুই চোখের মণি বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। বহু কষ্টে দম নিতে নিতে ও বলে, ‘আপনি ঘরে যান, ভাত দিতাছি।’

ধবধবে সাদা ভাতের ওপর হামলে পড়ে শাজান গাছুয়া। আজ মোজাম্মেলের বাড়ির সাত সাতটা নারিকেল গাছে উঠেছে সে। টাকার ভাগ দিতে হবে বলে কাউকে সঙ্গে রাখেনি। দুই পায়ের জায়গায় জায়গায় এখন জ্বলছে। চামড়া ছড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। এসব কাউকে জানালে নিজের অক্ষমতাই প্রকট হয়ে উঠবে। তাই কাজ সেরে শান্তমতো ঘরে ফিরে এসেছে শাজান। মানুষটা ভাত খেতে বসলে সখীতন মেয়েকে ঘরে আটকে রাখে। বন্দি মেয়ে এখন তার শোধ তুলছে। দরজায় ধমাধম বাড়ি মারছে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে ঘরের ভেতরে খণ্ডপ্রলয় হচ্ছে। শব্দের তাড়নায় উঠানে ধান খুঁটতে থাকা শালিকেরা এক পা দুপা করে পিছিয়ে যাচ্ছে।

শাজান সিগারেটের গায়ে আগুন দিতে দিতে বলে, ‘ওহিদ কবিরাজের ওষুধে নাকি কাজ হয়।’ নির্বাক সখীতন সাগ্রহে বলে ওঠে, ‘আমিও শুনছি। চলেন একদিন মেয়েকে নিয়ে যাই।’

.

সারাদিনের কাজের ফাঁকে আজ মেয়েকে চুমুতে চুমুতে অস্থির করে তুলেছে সখীতন। মেয়ে আজ তাকে মামাবলে ডেকেছে। পষ্ট শুনেছে সখীতন। শুনে হাতের কাজ ফেলে শাজানের কাছে ছুটে গেছে। বৃত্তান্ত শুনেও শাজান নির্বিকার থেকেছে। তাতে উচ্ছ্বাস কমেনি পাখিতনের মায়ের। মেয়ের মুঠোর মধ্যে একটা আস্ত সবরি কলা দিয়ে স্বামীকে নিজের ইচ্ছের কথা বলেছে, ‘করবেজের কাছে যাওয়াতেই কাজ হইছে। আপনি মাইয়াটারে একটু দেখলে আমি আরেকবার করবেজ বাড়ি যাইতাম।’

মানুষটার কাছ থেকে আশ্বাস না পেলেও মেয়েকে নাইয়ে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে সখীতন। যত সহজে কাজগুলোর কথা বলা হলো, এসব কিছুই করা সহজ না ওর জন্য। বরং এর চেয়ে কম শ্রম আর সময় ব্যয় করে সে ঘরকন্নার কাজ সেরে ফেলতে পারে।

ছলছলে দৃষ্টিতে মেয়েটাকে একবার দেখে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়েছে সখীতন। পরিশ্রান্ত সখীতনের পা চলে না। তবু সে হাঁটে আর হাঁটে। যেন হাঁটতে হাঁটতে নিজের সব ক্লান্তি অতিক্রম করে উঠতে চায়।

সখীতনের শরীর দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেলে শাজান শরীর টান টান করে দাঁড়ায়। চৌকাঠে দাঁড়ালে দেখা যায় বহু দূর পর্যন্ত কেউ নেই। সবুজ চাদরে ঢাকা মাঠের ওপরে রোদ হামলে আছে শুধু। এক দল পাখিও উড়ছে। চোখ জ্বলে শাজানের। পাখিতন কোথা থেকে উড়ে এসে বাপের হাত ধরে।

অদ্ভুত এক ভাবনায় নিমজ্জিত হতে হতে শাজান ধামা থেকে বাটিতে মুড়ি তোলে। মেয়ের সামনে বাটিটা ধরে সে আদুরে কণ্ঠে বলে, ‘খা মা।’ পাখিতন যত না খায় তার চেয়ে বেশি ছড়ায়। তবে যতটুকু খায় ততটুকুতেই কাজ হয়। দেখতে দেখতে ওর পাখি দেহটা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে পাখিতনের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সফেদ ফেনা বেরিয়ে এসে ওর ঠোঁটে লেগে থাকা মায়ের চুম্বনের দাগ মুছে দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউচ্চাশা
পরবর্তী নিবন্ধ১০ রানে অলআউট মঙ্গোলিয়া!