পাক-ভারত দুই দেশের যৌথ সমাধানই একমাত্র পথ

কাশ্মীর সংকটে উত্তেজনা নয়

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শনিবার , ১০ মে, ২০২৫ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত কাশ্মীর। অনেক সভ্যতার মিলনস্থল। পারস্য মধ্যএশিয়া চীন ও ভারতীয় সভ্যতার মিলন হয়েছে কাশ্মীরে। ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে প্রতিটি সভ্যতাই যেন পর্বতবেষ্টিত কাশ্মীর উপত্যকার সীমানায় এসে থমকে গেছে। কেউ এসে এককভাবে একে দখল করতে পারেনি। কাশ্মীর শীতল ও নিরিবিলি হওয়ায় ধ্যানজ্ঞান সাধনায় এলাকাটি বেশ উপযোগী। ফলে কাশ্মীর ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র। ভারতীয় সভ্যতার অগণিত তথ্য ও উপাখ্যান লিখিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে কাশ্মীর থেকে। যুগান্তকারী সব জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে এই জনপদে। দক্ষিণ এশিয়া আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারতপাকিস্তান সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটেছে। সীমান্তে গুলির লড়াই কূটনৈতিক হুমকি, যুদ্ধ মহড়া, আকাশ ও স্থলসীমা বন্ধের মতো পদক্ষেপ এবং চীনের প্রকাশ্য পাকিস্তানসমর্থন এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এক ভয়াবহ মোড় নিচ্ছে। ভারত ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে এই অঞ্চলে আর চীনপাকিস্তান জোট আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও নিজের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবছে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে দুইবার যুদ্ধ হয়েছে। উভয়েই এখন পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে। পুলওয়ামার ঘটনার পর পেহেলগামকে কেন্দ্র করে আবারও যুদ্ধংদেহি অবস্থানে দুই দেশ। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে ভারত আর পাকিস্তানের এই সংঘাতের কারণ।

কাশ্মীর সমস্যায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল : ১৯৪৭ সালের দেশভাগের শর্ত অনুসারে এটি হচ্ছে মালিকানার প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব। ভারতের দাবি কাশ্মীর তার অবিচ্ছেদ্য অংশপাকিস্তান এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত দখলদার কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতা বা পাকিস্তানে যাওয়ার দাবি ভারতের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। পাকিস্তানের দৃষ্টিতে কাশ্মীর সমস্যা হচ্ছে ‘অমীমাংসিত দেশভাগ’। এই বিরোধের সূত্র থেকেই ভারতপাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। যুদ্ধ চলাকালেই ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি কাশ্মীর সমস্যাকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলে ভারত। জাতিসংঘ তারপর বিভিন্ন রেজুলেশন পাস করে। প্রথম রেজুলেশন (১৯৪৮) অনুসারে জাতিসংঘ একটি কমিশন (ইউএনসিআইপি) তৈরি করে। ইতিহাস বলছে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার আগে থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট নামে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল কাশ্মীর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান যে কোনো রাষ্ট্রেই যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিটবালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে।

পাকিস্তানচীন কৌশলগত সম্পর্ক ও ভারতের উদ্বেগ : এই সংকটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে চীনপাকিস্তান সম্পর্ক। লাহোরে চীনা কনসাল জেনারেল ঝাও শিরেন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন চীন পাকিস্তানের পাশে ছিল আছে এবং থাকবে। এটি শুধু এক কূটনৈতিক বার্তা নয় বরং ভারত ও তার মিত্রদের উদ্দেশ্যে একটি কৌশলগত সতর্কবার্তা। চীনের এই অবস্থান পাকিস্তানকে মনোবল ও কৌশলগত আশ্রয় দিয়েছে। চীন এর মধ্যেই পাকিস্তানে অবকাঠামো প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। চীনপাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) এবং গোয়াদার বন্দর নিয়ে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যেকোনো আগ্রাসন সরাসরি চীনের স্বার্থে আঘাত বলে গণ্য হতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাবেক কংগ্রেস বিধায়ক ইউডি মিঞ্জকের বিতর্কিত এক পোস্টে লিখেন যুদ্ধ হলে ভারতের পরাজয় নিশ্চিত কারণ তাকে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনকেও মোকাবিলা করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত একসঙ্গে দুই শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে কিনা তা এখন বড় প্রশ্ন। চীনের উত্থান ও পাকিস্তানের ওপর সরাসরি সমর্থন এক নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। ভারতের এই সংকটকালে ঐতিহ্যগত মিত্র যেমন রাশিয়া, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্রও অনেকটাই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ফলে ভারত ক্রমেই নিজ অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক সমীকরণ ও বাংলাদেশের অবস্থান : বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় চারটি বড় ধারা স্পষ্ট ভারত এখানে আঞ্চলিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন লাভ করছে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সমর্থন খুঁজছে তারা চীনের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতবিরোধী ঘাঁটি গড়তে পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘সতর্কতার’ সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা। ভারত যদি চীনপাকিস্তান জোটের বিরোধিতায় সরাসরি পথে নামে তবে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হবেই। একদিকে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক অন্যদিকে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও অবকাঠামো সহযোগিতাএই দুইয়ের মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করাটাই বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদিও এখনো পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনা কম বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন তবুও সীমিত সংঘর্ষের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সীমান্তে রকেট হামলা, বিমান প্রতিরক্ষা সক্রিয়করণ ও সামরিক মহড়াগুলো যুদ্ধ প্রস্তুতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে যা শিগগির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। দুই পরমাণু শক্তিধর ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা শুধু দুই দেশের জন্য নয় বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক গভীর বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে। এর অর্থনৈতিক মানবিক ও পরিবেশগত মূল্য হবে ভয়াবহ। এ প্রেক্ষাপটে চীনপাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা যেমন ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল করছে তেমনি বাংলাদেশের জন্য তৈরি করছে এক কৌশলগত বাস্তবতা যেখানে ভুল সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো সঠিক সময়ে সঠিক প্রস্তুতি নেওয়া। শুধু অস্ত্র বা সামরিক মহড়ায় সীমাবদ্ধ নয় বরং কূটনৈতিকভাবে বহুমাত্রিক জোট অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনমনে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। যুদ্ধ না চাইলেও যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে হবে আর সেটিই আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ভারসাম্য রক্ষার কৌশল: যুক্তরাষ্ট্র প্রথমদিকে কাশ্মীর হামলার নিন্দা জানালেও দুপক্ষকে দায়িত্বশীল সমাধান খোঁজার আহ্‌বান জানিয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বারবার বলেছে আমরা চাই ভারত ও পাকিস্তান সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিরসন করুক। কিন্তু বাস্তবে ওয়াশিংটন ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্প্রসারণ করেছে পাকিস্তানের ওপর চাপ বজায় রেখেছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আরও দৃশ্যমান পদক্ষেপের জন্য চীনা প্রভাব রুখতে ভারতকে আঞ্চলিক কৌশলগত অংশীদার হিসেবে এগিয়ে নিচ্ছে পাকিস্তান এটিকে ভারতপ্রীতি হিসেবে দেখে ক্ষুব্ধ।

রক্তাক্ত কাশ্মীর স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধান : কাশ্মীর শুধু একটি ভূখণ্ড নয় এটি দক্ষিণ এশিয়ার পুরো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। আজকের বিশ্বে যেখানে চীনযুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর সেখানে কাশ্মীর সংকট দক্ষিণ এশিয়াকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা ছাড়া এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়। অতএব এই মুহূর্তে কূটনৈতিক সংযম ও সুবিবেচনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। অন্যথায় দক্ষিণ এশিয়া ফের রক্তাক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মুখোমুখি হবে। ভারতপাকিস্তানের উত্তেজনার প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে পড়বে। বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোকে বলা যে ভারতপাকিস্তানের উচিত কাশ্মীর ইস্যুর সমাধান করা কিংবা ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির উচিত এখানে মধ্যস্থতা করা। কারণ এই উত্তেজনা পুরো অঞ্চলের জন্যই ক্ষতিকর। কিন্তু এখন বাংলাদেশের উচিত ওআইসিসহ অন্যান্য ফোরামগুলোকে বলা যে কাশ্মীর ইস্যুটা স্থায়ীভাবে সমাধান করা উচিত। তাহলে এই অঞ্চলে উত্তেজনার উৎসটা বন্ধ হবে। জম্মুকাশ্মীর সংকটে উত্তেজনা নয় পাকভারত দুই দেশের যৌথ সমাধানই একমাত্র পথ।

লেখক

ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৌদ্ধদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র একটি দিন
পরবর্তী নিবন্ধঅসাধারণ ইল্‌ম ও বেলায়ত সমৃদ্ধ মহান ওলী আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটী (রাহ.)