ব্যবসায় সহযোগিতা করার জন্য দেওয়া ধারের টাকা ফেরত চাওয়ায় উল্টো চাঁদাবাজি মামলার শিকার হয়ে পথে বসেছেন আবু তাহের নামের এক স্কুল শিক্ষকের পরিবার। অথচ ধার দেওয়া টাকার বিপরীতে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিও রয়েছে। সেই চুক্তি অগ্রাহ্য করে টাকা গ্রহীতা ব্যবসায়ী তাঁর পরিবারের নারী সদস্যকে দিয়ে ভুক্তভোগী স্কুল শিক্ষকসহ পরিবার সদস্যদের উল্টো এখন হয়রানি করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্কুল শিক্ষকের পরিবারের প্রতি এমন অমানবিক ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নে। শুধু খুটাখালীর আবু তাহের নন, এই চক্রের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন বহু পরিবার।
শুধু তাই নয়, চাঁদাবাজির ধারার মামলা করলে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক দীর্ঘ তদন্ত কার্যক্রম শেষে ঘটনা সত্য নয় এবং ধারের টাকা ফেরত চাওয়ায় এই ‘মিথ্যা’ অভিযোগ করা হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এর পর আদালত শুনানি শেষে সেই চাঁদাবাজির মামলা খারিজ করে দেন। ভুক্তভোগী খুটাখালী কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের সিনিয়র শিক্ষক আবু তাহের জানান, ২০২২ সালে খুটাখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ পাড়ার মৃত সোলতান আহমদের ছেলে আবদু শুক্কুর ব্যবসার পরিধি বাড়াতে তাঁর (শিক্ষক) দ্বারস্থ হন। এ সময় ১২ লাখ টাকা ধার হিসেবে চান। এমনকি তাঁর বিভিন্ন স্বজনদের মাধ্যমেও তদবির করালে আবদু শুক্কুরকে তিনি সেই টাকা দেন এবং ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে উভয়ের মধ্যেই চুক্তিপত্র সম্পাদন হয়। পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে অনেক হয়রানির পর পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকী সাত লাখ টাকা দিতে গড়িমসির আশ্রয় নেন। এমনকি পাওনা বাকী টাকা ফেরত চাওয়ায় ব্যবসায়ী আবদু শুক্কুর খুটাখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ পেঠানের কাছে নালিশ করেন। এর পর নুর মোহাম্মদ পেঠানের মধ্যস্থতায় আবদু শুক্কুর সাত লাখ টাকার একটি চেক এবং ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়–নির্ধারিত তারিখের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তার বসতভিটা বন্ধকী হিসেবে থাকবে। পরবর্তীতে টাকা ফেরত না দিয়ে আবদু শুক্কুর তার পরিবারের সদস্য আইরিন সুলতানা রিমিকে বাদী বানিয়ে পাওনাদার শিক্ষক আবু তাহেরের বিরুদ্ধে উল্টো চাঁদাবাজির ‘মিথ্যা’ মামলা দায়ের করেন।
উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকরিয়া থানার উপ–পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মুহাম্মদ আল–ফুরকান দীর্ঘ সময় অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম চালান। কিন্তু চাঁদাবাজি করেছেন মর্মে শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য–উপাত্ত হাজির করতে পারেননি বাদীপক্ষ। এর পর তদন্ত কর্মকর্তা সবকিছু বিশ্লেষণ ও যাচাই করে চাঁদাবাজির কোনো সত্যতা পাননি মর্মে পেনাল কোডের ২১১ ধারায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। আদালত এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেন।
প্যানেল চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ পেঠান বলেন, আবদু শুক্কুর একসময় ব্যবসা করতেন। সেই সূত্রে আবু তাহের তাকে ১২ লাখ টাকা দেন। পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দিলেও বাকী সাত লাখ টাকা ফেরত না দেওয়ায় আমি উভয়পক্ষের সমঝোতায় একটি চুক্তিপত্র করি। কিন্তু পরে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে হয়রানি করার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
স্থানীয় একাধিক সচেতন ব্যক্তি ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন–আবদু শুক্কুর আপাদমস্তক একজন প্রতারক। পরিবারের নারী সদস্যদের দিয়ে আবদু শুক্কুর দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে আসছেন। তারা আবার ইয়ারা কারবারের সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত। চকরিয়ার আলোচিত সাড়ে ১২ লাখ পিস ইয়াবা পাচারের (পুলিশ কর্তৃক জব্দ) ঘটনায়ও এই পরিবারের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
চকরিয়া মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এস এম মনজুর আলম বলেন, এই চক্র আমার কলেজপড়ুয়া সন্তানকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে সাজানো ধর্ষণ মামলায় তাকে ফাঁসিয়ে জেল খাটায়।
আরেক ভুক্তভোগী ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের খোদাইবাড়ি এলাকার মো. কিবরিয়ার মা কোহিনুর বেগম বলেন, আমার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আমাদেরকে সপরিবারকে পথে বসিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আমার আহ্বান, এই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক।
চকরিয়া থানা পুলিশ জানায়, আবদু শুক্কুর ও তাঁর পরিবারের নারী সদস্যরাও মাদকের কারবারে জড়িত। ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল চকরিয়া থানা পুলিশ খুটাখালী নদী থেকে ১২ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। এ সময় গ্রেপ্তার মাদক কারবারির দেওয়া জবানবন্দিতে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উঠে আসে।
ভুক্তভোগী শিক্ষক আবু তাহের বলেন, মিথ্যা মামলার কারণে আমার মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত এবং মিথ্যা অভিযোগকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথিত ব্যবসায়ী আবদু শুক্কুর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার কাছে আবু তাহের নামে কোনো শিক্ষক টাকা পাচ্ছেন না। অপরদিকে চাঁদাবাজি মামলার বাদী আইরিন সুলতানা রিমি সব দোষ অস্বীকার করে বলেন, আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই।