মানুষ মানুষের জন্য। পৃথিবীতে ঋণ করেনি এমন মানুষ খুবই কম। নবীজিও ঋণ করেছেন। জীবনের তাগিদে ঋণ তো করতেই হয় তবে ঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে রাসুল (সা.)-বারবার সতর্ক করেছেন। তা ছাড়া যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের ফজিলতও রয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে চলতে গেলে কখনো কখনো অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। এই সহযোগিতার একটি পর্যায় হলো ঋণের আদান–প্রদান। ঋণ মূলত আমানত। আমানত রক্ষায় কোরআনে নির্দেশনা রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহতাআলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা আমানত তার প্রাপককে দিয়ে দাও। (সুরা–৪ নিসা, আয়াত : ৫৮)। ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোরআন কারিমে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি আল্লাহতাআলা নির্দেশ দিয়েছেন যেন মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন ও ওসিয়ত পালনের পূর্বেই তাঁর ঋণ পরিশোধ করা হয়। (সুরা–৪ নিসা, আয়াত : ১১–১৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-তাঁর সাহাবিদের জানাজা নামাজ পড়াতেন না যদি তাঁর ঋণ অপরিশোধিত থাকত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি অহংকার, গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ ও ঋণ–এই তিন বিষয় থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হজরত আলী (রা.)-বর্ণনা করেন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এরশাদ করেন যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। রাসুল (সা.)-ঋণ আদায় করার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে উহুদ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন আমি চাই না উহুদ পাহাড় আমার জন্য স্বর্ণে পরিণত করে দেয়া হলেও এর একটি দিনার আমার নিকট তিন দিনের বেশি সময় থাকুক ; হ্যাঁ, যদি কোনো দিনার আমি আমার ঋণ পরিশোধের জন্য রেখে দিই সেটা ভিন্ন।
ইসলামে ঋণ আদান–প্রদান করা বৈধ। এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম লোক যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে। ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুনাহই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। মুমিন ব্যক্তির রুহ তাঁর ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে যতক্ষণ না তাঁর পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করা হয়। মুহাম্মদ ইবনে জাহাস (রা.)-বলেন আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বসে ছিলাম। এমন সময় তিনি আকাশের দিকে তাঁর মাথা ওঠান তারপর তাঁর হাত ললাটের ওপর স্থাপন করে বলেন সুবাহানআল্লাহ! কী কঠোরতা অবতীর্ণ হলো! আমরা ভয়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। পরদিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসুলুল্লাহ! ওই কঠোরতা কী ছিল যা অবতীর্ণ হয়েছে? রাসুলুল্লাহ (সা.)-বললেন যার নিয়ন্ত্রণে আমার প্রাণ তাঁর কসম! যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয় আবার জীবন লাভ করে ; আবার শহীদ হয় এবং আবার জীবিত হয় পরে আবার শহীদ হয় আর তার ওপর অপরিশোধিত ঋণ থাকে তবে তার পক্ষ থেকে সে ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
নবী করিম (সা.)-বলেছেন যে ব্যক্তি পরিশোধের নিয়তে মানুষের সম্পদ গ্রহণ করে আল্লাহতাআলা তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করে দেন। আর যে তা বিনষ্ট করার নিয়তে গ্রহণ করে থাকে আল্লাহ তাকে বিনষ্ট করে দেন। রাসুল (সা.)-বলেন ঋণ পরিশোধ করা ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে হাশরের মাঠে নিজের নেকি থেকে ঋণের দাবি পূরণ করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-সাহাবিদের ঋণ পরিশোধের দোয়াও শিখিয়েছেন আল্লাহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক (অর্থ–হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল রিজিকের মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচান এবং আপনার দয়া ও করুণা দিয়ে অন্যদের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন)। রাসুল (সা.)-বলেন এই দোয়ার ফলে পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও আল্লাহ তার ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করে দেবেন। তাই কোনোভাবেই ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হলে ঋণদাতার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নিতে হবে অথবা দায়িত্বশীল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান,সংস্থা বা সংগঠনের শরণাপন্ন হয়ে ঋণ মওকুফ বা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই ঋণ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। ঋণ আদায়ে কঠোরতাও আরোপ করা যায়। আমর ইবনে শারিদ (রহ.)-তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন ঋণ পরিশোধ না করলে তার মান–সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ করা যায় এবং তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-বলেন এর অর্থ হলো তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করবে এবং তাকে আটক করা যাবে। জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে তার পাওনা আদায়ের কড়া তাগাদা দিল। সাহাবায়ে কিরাম তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.)-বললেন তাকে ছেড়ে দাও। কেননা পাওনাদারের কথা বলার অধিকার রয়েছে।
বর্তমান সমাজে অনেকে ঋণ গ্রহণের পর ওই টাকাকে নিজের সম্পদ মনে করেন। অনেকে টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন। হজরত আলী (রা.)-বর্ণনা করেন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এরশাদ করেন যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। ঋণের বোঝা এতটাই ভারী যে পরকালে সব হিসাব থেকে পার পাওয়া গেলেও ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। রাসূল সা:-বলেন ঋণ পরিশোধের পাপ ছাড়া শহীদের সব পাপই মাফ দেয়া হবে। তাই ঋণ পরিশোধে গড়িমসি বা টালবাহানা নয় ; বরং জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব থেকে বাঁচা এবং জান্নাতের পথ সহজ করতেই ঋণ আদায়ে মনোযোগী হতে হবে। আর যে ঋণ আদায়ে সচেষ্ট হয় আল্লাহ তাকে সক্ষমতা দান করেন। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.)-ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয় তার ভাইয়ের পক্ষে তার কাছ থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই।
ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম : কতক ব্যক্তি এমন রয়েছে যারা ঋণ বা করজ নেয়ার পর তা আদায়ে গড়িমসি ও টালবাহানা করতে থাকে। এ গড়িমসি ও টালবাহানা যদি অভাবের কারণে হয় তাহলে তা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সক্ষমতা থাকা সত্ত্েবও কতক লোকের অভ্যাস হলো অকারণে পাওনাদারকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া এবং টালবাহানা করে বেড়ানো। উপকারী পাওনাদারকে এভাবে কষ্ট দেয়া তার ওপর জুলুম করার শামিল। এমনটি করতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.)-বলেন রাসুল (সা.)-বলেছেন সক্ষম ব্যক্তির ঋণ আদায়ে গড়িমসি করা অত্যাচারের শামিল। তোমাদের কারও প্রতি ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব দিলে সে যেন তা গ্রহণ করে। আমাদের সমাজের একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে না। ফলে এই অপকর্মের খেসারত গুনতে হয় গোটা জাতিকে। এভাবে ঋণখেলাপিরা হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার নষ্ট করে চলেছেন। যথাযথ আইনের অনুশাসন এবং দ্বিন বিমুখিতাই এই লাগামহীন ঋণখেলাপির মূল কারণ। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত হক্কুল ইবাদ নষ্টকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না। আর জনগণের সম্পদ লুট করার পরিণাম আরো ভয়াবহ। কেননা ব্যাংক ঋণের সঙ্গে অগণিত মানুষের সম্পদ জড়িত। ঋণ পরিশোধের প্রাণান্ত চেষ্টার পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা ইসলামের শিক্ষা। হজরত আবু ওয়ায়েল (রা.)-থেকে বর্ণিত তিনি বলেন হজরত আলী (রা.)-এর কাছে এক ক্রীতদাস এসে বলল আমাকে সাহায্য করুন আমি চুক্তির টাকা আদায় করতে পারছি না। তখন হজরত আলী (রা.)-তাকে বললেন আমি কি তোমাকে এমন কয়েকটি শব্দ শিখিয়ে দেব যা আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-শিখিয়েছেন? যদি তোমার ওপর সায়ির পাহাড় পরিমাণও ঋণ থাকে তবু আল্লাহতায়ালা তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। এ ছাড়া হাদিসে আরো দোয়া রয়েছে সেগুলো বেশি বেশি পড়লে এবং ঋণ পরিশোধের নিয়ত করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে আল্লাহ ঋণমুক্ত করে দেবেন। ইনশাআল্লাহ! আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে তালবাহানা থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। ঋণ থাকলে তা মৃত্যুর আগেই পরিশোধ করার তাওফিক দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হারাম ছাড়া হালাল দ্বারা যথেষ্ট করুন এবং আপনার অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে অন্যদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করুন! মহানআল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি আমাদেরকে হেদায়েতের সরলপথে পরিচালিত করুন। আমাদেরকে খাঁটি মুমিন হওয়ার তওফিক দিন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট