পাঁচ গুলিবিদ্ধসহ ৩৮ জন আহত হওয়ার দাবি ছাত্রদল ও শিবিরের

চকবাজারে সংঘর্ষের ঘটনা

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৩ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৩৫ পূর্বাহ্ণ

নগরের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের এক ছাত্রকে পুলিশে সোপর্দ করা নিয়ে সোমবার রাতে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৩৮ জন আহত হওয়ার দাবি করেছে সংগঠন দুটি। এর মধ্যে ছাত্রশিবির তাদের তিনজন কর্মী গুলিবিদ্ধ ও ২২ জন আহত হওয়ার দাবি করে। ছাত্রদলের দাবি, তাদের দুজন গুলিবিদ্ধসহ ১৬ জন আহত হয়েছে। উভয় সংগঠনের নেতারা এ ঘটনার জন্য পরস্পরকে দায়ী করে। পাল্টাপাল্টি বিবৃতিও দিয়েছেন উভয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তবে এ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ছাত্রশিবির হামলা করেছে দাবি করে গতকাল বিকালে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রদল। চকবাজার থানা, মহসীন কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদল যৌথভাবে মিছিল করে। চকবাজারের কাতালগঞ্জ বৌদ্ধমন্দির থেকে শুরু করে গুলজার মোড় অতিক্রম করে চট্টগ্রাম কলেজ হয়ে গণি বেকারি মোড়ে এসে শেষ হয় মিছিলটি। চট্টগ্রাম কলেজ অতিক্রমকালে মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রদলের কিছু কর্মী চট্টগ্রাম কলেজে ঢোকার চেষ্টা করে। কয়েকজন কলেজ গেটে লাথি দেয়। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। মিছিল থেকে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা দাবি করেন, চকবাজার থানার ভেতর ছাত্রশিবির তাদের ওপর হামলা করলেও চুপ ছিল পুলিশ।

জানা গেছে, গত সোমবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে আরিফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে চকবাজার থানায় সোপর্দ করে মহসীন কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তবে আরিফকে নিজেদের কর্মী দাবি করে ছাত্রশিবির। পরে তাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় যান ছাত্রশিবিরের নেতকর্মীরা। সেখানে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে এক পর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তারা। শিবিরের কর্মীরা অবস্থান নেন অলি খাঁ মসজিদ এলাকায় আর ছাত্রদলের কর্মীরা গুলজারের সামনে। রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় গোলজার মোড়সহ আশেপাশ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেশিরভাগ নেতাকর্মীর হাতে লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র ছিল। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারসেল ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। পরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে দুই পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নেয়। এরপর সোমবার দিবাগত রাত প্রায় ৩টার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।

ছাত্রদল দাবি করেছে, তাদের ২ জন গুলিবিদ্ধ ও ১৬ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে মো. রুবেল ও মো. কাউসার নামে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া আহত অন্যরা হচ্ছেন রুম্মান আফজার, মো. কাউছার, সাকিবুল হক, মো. বোরহান, মোহাম্মদ ইমতিয়াজ, আবু রায়হান চৌধুরী, মো. ইলিয়াস, আবদুল্লাহ আল মামুন, সাইদুল ইসলাম ফয়সাল, সিফাতুল রাফসান, আশিক মজমুদার অনিক, মো. আশিক, মো. সাব্বির, মো. রবিউল ও মোহাম্মদ রাজু। আহতদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন নগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সামিয়াত আমিন জিশান।

এদিকে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা জানান, তোহা, আতিক ও জাবেরুল ইসলাম নামে তাদের তিনজন কর্মী গুলিবিদ্ধ এবং ২২ জন আহত হয়েছেন।

কী বলছে পুলিশ : চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল কবির আজাদীকে বলেন, আরিফ নামে এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে ছাত্রদল। আবার তাকে নিজেদের কর্মী দাবি করে ছাত্রশিবির। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করি।

আরিফকে আটক করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কাউকে আটক করিনি। এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। ‘ছাত্রদলের দাবি থানার মধ্যে পুলিশের সামনেই তাদের কর্মীদের ওপর ছাত্রশিবির হামলা করেছে’। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ রকম কিছু হয়নি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক আজাদীকে জানান, চকবাজারে সংঘর্ষে আহত চারজনকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়। এরা হচ্ছেন মো. ফয়সাল, রাফি নূর, রুবেল ও মামুন।

যা বললেন শিবির সভাপতি : আহত শিবিরকর্মীদের দেখতে গতকাল দুপুরে চমেক হাসপাতালে যান ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর উত্তরের সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েল। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চকবাজারকেন্দ্রিক কিছু চাঁদাবাজকে আরিফ এবং স্থানীয় কিছু জনশক্তি বাধা দেয়। তখন থেকে আরিফ সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয়। সোমবার একা পেয়ে কিছু চাঁদাবাজ তাকে আঘাত করে। এরপর থানায় নিয়ে যায়। এটা শোনার পর তার ব্যাচমেট এবং চকবাজার থেকে কিছু লোক পাঠায় তাকে নিয়ে আসার জন্য।

তানজীর বলেন, আমি ওসির সঙ্গেও কথা বলেছি। ওসি বলেছেন, আরিফ ছাত্রলীগ করত। তবে কোনো পোস্ট নেই, কিছু ছবি আছে। আমি বলেছি, ছবি থাকলেই ছাত্রলীগ করবে তা না। গত ১৬ বছরের পরিবেশ পরিস্থিতিতে ক্যারিয়ারের স্বার্থে অসংখ্য মানুষের সাথে ছবি তুলতে হয়েছে। আরিফ আমাদের ত্যাগী কর্মী। জুলাইআন্দোলনে আহত হয়েছে।

তিনি বলেন, সমাধানের পর আমাদের ভাইয়েরা চলে আসার পথে যুবদলের এমদাদুল হক বাদশার নেতৃত্বে থানার ভেতর হামলা করেছে। এরপর পুরো চট্টগ্রাম থেকে সকল সন্ত্রাসীকে একত্রিত করে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করেছে। এতে তোহা, আতিক ও জাবেরুল ইসলাম তিনজন গুলিবিদ্ধ এবং ২২ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আহত ব্যক্তিরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের যে কয়েকজন লোকজন ছিল তাদের কাছে সর্বোচ্চ লাঠি দেখেছেন। কিন্তু তাদের হাতে রামদা, কিরিচ, দেশীয় অস্ত্র ও ককটেল ছিল। এ রকম অসংখ্য প্রমাণ দিতে পারব।

অভিযোগের বিষয়ে এমদাদুল হক বাদশা আজাদীকে বলেন, সব মিথ্যে এবং বানোয়াট কথা। শিবির ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন করছে। এখন নিজেদের এই অপকর্ম ঢাকতে মিথ্যা রটনা রটাচ্ছে। ছাত্রলীগের কর্মীকে পুলিশে তুলে দেয় মহসীন কলেজ ছাত্রদল। এখানে যুবদলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

কী বলছে ছাত্রদল : নগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিন সাংবাদিকদের বলেন, মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের এক কর্মীকে ছাত্রদল পুলিশে সোপর্দ করে। তখন শিবির নেতৃবৃন্দ প্রশাসনকে লাঞ্ছিত করে এবং মব সৃষ্টি করে। তারা থানার ভেতরে বিএনপি ও ছাত্রদলকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। তিনি বলেন, অতীতে যারা ছাত্রলীগ করত তারা এখন শিবিরকর্মী দাবি করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা আছে। মহসীন কলেজেও এমনটি দেখছি। শিবিরের দ্বিমুখী আচরণে আমরা সবাই বিব্রত। ১৭ বছর যারা গুম, খুন ও অপকর্মের সাথে জড়িত তারা কীভাবে ছাত্রশিবির কর্মী হয় বুঝে আসছে না।

শিবিরের দাবি, তাদের কর্মীদের গুলি করেছে ছাত্রদল’। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তুহিন বলেন, এ ধরনের কমকাণ্ড ছাত্রদল অতীতেও কখনো করেনি, সোমবার রাতেও করেনি। ছাত্রদল বিশৃঙ্খল কোনো কিছুতে বিশ্বাসী না। আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ করেছি। প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখেছি, তারা সশস্ত্রভাবে আমাদের নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা করেছে। আমাদের একজন নেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। রুবেল নামে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি আছে। আরো ১০/১৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। শিবিরের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিহার করে সুস্থ ও সুন্দর ধারার ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসে।

বিক্ষোভ মিছিল : ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর সোমবার রাতে ‘গুপ্ত সংগঠন শিবির’ ন্যক্কারজনক হামলা করেছে দাবি করে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে ছাত্রদল। মিছিল থেকে দাবি করা হয়, আরিফ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মিজানের অনুসারী ছিল। তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে আরিফ একাধিকবার ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা করে। সোমবার রাতে পুলিশের সহায়তায় শিবির আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্রদলের ওপর হামলা করেছে।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন চকবাজার থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আলাউদ্দিন আলো, সদস্য সচিব ইমরান লিটন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক সারফরাস সিজ্জি নূরী, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক বোরহানুল ইসলাম, মহসীন কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক গিয়াস উদ্দিন সারজিল ও সদস্য সচিব মো. জাহাঙ্গীরসহ নেতৃবৃন্দ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্র
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আরেকজনের মৃত্যু