পহেলা বৈশাখ : আবহমানকালের লালিত ঐতিহ্য, জাতীয় উৎসব

| সোমবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব। আমাদের আরো অনেক উৎসব আছে। এর মধ্যে কিছু ধর্মীয় উৎসব আর আছে কিছু ঋতু উৎসব। আজ যাত্রা শুরু হলো নতুন আরেকটি বাংলা বছরের। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বছর ১৪৩২। তাকে স্বাগত জানাতে, উদযাপন করতে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ এক কাতারে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন এটি। বড় দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রধান উৎসব। এটা বাঙালির প্রাণের উৎসব।

পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে। সম্রাট আকবরই প্রথম বাংলা সন প্রবর্তন করেন। শুরুতে পহেলা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা কৃষক, জমিদার ও ভূস্বামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য এ উপলক্ষে মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো। ধীরে ধীরে তা ব্যাপকতা পায়, নানা উৎসবঅনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে সার্বজনীনশুভবোধ আর কল্যাণ চেতনার প্রতীক। সত্যিকার অর্থে বাংলা নববর্ষ একমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব। প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি উপাদান হিসেবে বাংলা নববর্ষ পালিত হলেও পরে রাজনৈতিক আন্দোলন দিনটিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র সংগীত ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ শুরু হলে ছায়ানট পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে রবীন্দ্র সংগীতের আয়োজন করে। আয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে এ ছিল প্রতিবাদ। সেই থেকে বাঙালির আত্ম পরিচয় ও আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের যাত্রা শুরু। বাঙালির ঘরে ঘরে এ দিন উৎসবের ছোঁয়া লাগে। পরস্পরের মঙ্গল কামনা এ দিনের সামাজিকতার অঙ্গ। দোকানি ও ব্যবসায়ীরা খোলে হালখাতা।

পহেলা বৈশাখ নিয়ে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেছেন, ‘আমাদের এখানে ধর্মনিরপেক্ষ আর কোনো জাতীয় উৎসব নেই। অসাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে পহেলা বৈশাখ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিগতভাবেও বৈশাখ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ফসলি মাস, অন্যদিকে কালবৈশাখী। সব মিলিয়ে বৈশাখ উদ্দীপনামূলক এক মাস, যা আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে।’

পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙালির জাতীয় উৎসব, আমাদের আবহমান কালের লালিত ঐতিহ্য। আর এ ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান কোনো গোষ্ঠী বা কোনো নির্দিষ্ট মতের মানুষের অনুষ্ঠান নয়। এটা সর্বজনীন, সব ধর্মবর্ণ ও মতের অনুষ্ঠান। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। তাই তো দলমত নির্বিশেষে, মানুষের স্রোতে বর্ণিল হয়ে ওঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বাঙালি মেতে ওঠে নিজস্ব প্রাণের আবহে। যার প্রধান প্রেরণা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সমগ্র সত্তা অস্তিত্ব ও অনুভবের সঙ্গে মিশে থাকা একটা প্রণোদনার নাম। এটা বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিক। প্রতিবছরই শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। দেশের কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে এবং নির্বিঘ্নে ও স্বচ্ছন্দে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। নববর্ষের অনুষ্ঠানে দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের যে রকম ঢল নামে, তাতে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। বর্ষবরণের মাধ্যমে বাঙালি তার শেকড়ে ফিরতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে পারে নতুনভাবে। বাঙালির প্রাণের আবেগ ও ভালোবাসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই দিনে।

গবেষকরা বলেন, নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামের মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুুবান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন।

পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। এ দিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখশান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হোক বছরের প্রথম দিন। শুভ নববর্ষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে