পহেলা বৈশাখে লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের স্বপ্নকথা

কুমার প্রীতীশ বল | বুধবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

পহেলা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় উৎসব। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের দিন। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের জন্য সংস্কৃতির ‘এক বিশাল পুনুরুত্থানের ছবি’ নির্মাণ প্রয়োজন। এই ‘ছবি’টি হবে লোকসংস্কৃতির একটি আদর্শ কল্পচিত্র। কল্পনা আর প্রাপ্তির ব্যবধান যত দুস্তর হোক, স্বপ্ন দেখতেই হবে। ‘একজন লাতিন দার্শনিক একবার বলেছিলেন, আমাদের স্বপ্ন দেখতেই হবে, কেননা স্বপ্ন না দেখলে আমরা তো কখনো জেগে উঠতে পারব না।’ তাই পহেলা বৈশাখে লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের স্বপ্ন দেখি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের জন্য ‘এক বিশাল পুনুরুত্থানের ছবি’র স্বপ্ন দেখেন; ‘যে, পুনুরুত্থান মানুষকে তার শেকড়ে এবং মাটিতে নিয়ে যাচ্ছে; সমষ্টির জীবনের ও ভালোবাসার কাছে, তার সামান্য চাওয়া-পাওয়া, তাঁর সম্মান এবং বিশ্বাসের জায়গাটায় নিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমাধ্যম আমাদের উৎপাদন নয়, তবে আমরা একে ব্যবহার করব, প্রয়োজন হলে আত্মস্থ করব। কিন্তু তা পশ্চিমের আরোপিত সূত্র মেনে নয়, বরং আমাদের চিরকালীন সৌন্দর্য, মূল্যবোধ ও ভালোবাসার সূত্র মেনে-’।
লোকসংস্কৃতি কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রীতি, পদ্ধতি, কাঠামোর মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। সৈয়দ জামিল আহমেদ এগুলোকে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছেন- ১. সংস্কৃত নাট্য প্রভাবজাত রীতি, ২. কথানাট্য, ৩. নাটগীতি, ৪. লৌকিক হাস্যরসাত্মক নাট্য, ৫. মিশ্রনাট্য এবং ৬. পুতুল নাচ। এছাড়াও আছে উপনিবেশিক নাট্যধারা। এখন তা সংস্কৃতির অংশ। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণে সবই অক্ষুণ্ন থাকবে। একের কারণে অন্যের বিনাশ ঘটবে না।
দেশকালের বাস্তবতায় হাজার বছর আগেই বাংলায় উন্নত শিল্পরুচি তৈরি হয়। সেই রুচিবোধ আজও প্রবাহমান। এই সমৃদ্ধ রুচি নির্মাণে পুতুল নাচ, গম্ভীরা, আলকাপ, লীলা, শাস্ত্রগান, ভাসান, পালা, কথকতা, লক্ষীর গান, বিচারগান, ঝুমুর, গীতিকা, ঘেটু, নাটগীত, পাঁচালী, লেটু, গাজীরগানসহ লোকসংস্কৃতির বিচিত্র অনুসঙ্গের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারী গানের কথা ভুলি কী করে? লোকপরম্পরায় এর চর্চার পাশাপাশি গাজন, রথযাত্রা, নবান্ন, মেলা, তাজিয়া ইত্যাদি উৎসব,পালা, পার্বণের আয়োজনকে সমৃদ্ধ করেছে। এমনিতেই বার মাসে তের পার্বণ। এই পার্বণকে ঘিরে লোকাচারে পূর্ণ লোকায়ত জীবন। ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ, ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামে জব্বারের বলিখেলায় এখন কাউকে ডাকতে হয় না।
লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটলে চাবাগানগুলোর মতো পাড়ায় পাড়ায়, নগরে মহল্লায় নাটমণ্ডল হবে। এখানে মাদারগীত, মনসার গান, আলকাপ, ঈমান যাত্রা, কুশান পালা, কবির গান হবে। বিনয় বাঁশীর শিষ্যদের ঢাকের শব্দে নাগরিকের ঘুম ভাঙবে। জহির উদ্দিন পালানের দেহতত্ত্বের গান নগরে তরুণের আড্ডায় গীত হবে। রেখারাণীর গান শুনার জন্য স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ থাকবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, তরুণ, যুবা, প্রাসাদবাসী নারী দল বেঁধে টিকেটের জন্য ছুটবে। রেখারাণীর ‘মহাপ্রভু নিলাচলে’ শুনে হাউমাউ করে কাঁদবে। আশরাফ আলীর ‘মনসার গান’ শুনে ফুঁপিয়ে উঠবে। পলানদার শিষ্যরা ‘যুগীপর্ব’ পরিবেশন করে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করবে। পুনা ফেরত চলচ্চিত্রকার পুঠিয়ার ‘মিছিল গান’ চিত্রায়িত করে পুরস্কার পাবে। ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্সিদী, লালন, হাসন, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের এলবাম বিক্রি মাসের পর মাস সেরা দশে থাকবে। শিল্পকলা একাডেমির যাত্রামঞ্চে প্রতিদিন টিকেট কেটে লোকে যাত্রা দেখবে।
সরকার বলেছেন, ‘গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে’। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ হলে অসংখ্য তরুণ, যুবা শেফালী ঘোষ, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের গান ডাউনলোড করবে। লোকসংস্কৃতির ই-ম্যাগাজিন ইন্টারনেটের কল্যাণে তারুণ্যের পাঠের অংশ হবে। গুগলে ছড়িয়ে পড়বে শ্রীকৃষ্ণলীলা, মাদার গীত, মনসার ভাসান, শীবের গাজন।
লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটলে ঘরে ঘরে লোক পুরাণের চর্চা হবে। চারণ শিল্পীরা রিভু সম্মানে পূজিত হবেন। দেশের ধনীদের তালিকায় চারণ শিল্পীর নাম যুক্ত হবে। চারণরা রচনা করবেন লোকসংস্কৃতির সোপান। অহীভূষণ ভট্টাচার্য ১৮৯৪ সালে ‘সুরথ উদ্ধার’ যাত্রায় বিবেক নামের চরিত্র সৃষ্টি করে যাত্রাশিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেন। যাত্রায় বিবেকের গান অপরিহার্য হয়ে ওঠে। যাত্রায় বিবেক গান পরিবেশন করে মানিকগঞ্জের শিল্পী বলাই দাস, উপেন দাস জেলার সর্বোচ্চ করদাতা হবেন। ময়মনসিংহের শিল্পী নিখিল সরকার দেশের সর্বোচ্চ পদক লাভ করবেন। অর্থের কারণে কারো শিল্পীসত্তা নষ্ট হবে না, এক বয়াতিকে দেখেছি, দেশ বিদেশে সুনাম ছড়ানোর পর কণ্ঠের সেই রসমঞ্জুরি লোপ পেয়েছে। নানা দুর্নাম তাঁর সঙ্গী। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ হলে তেমনটি হবে না। জয়দুর্গা অপেরার কালীপদ দাশ, বাবুল অপেরার মোহনলাল রায়, নিউ বাবুল অপেরার বাবুলাল রায়, দুলাল বিশ্বাস, নবরজ্ঞন অপেরার গৌরাঙ্গ আদিত্য, ঝিনাইদহের মহীতোষ বিশ্বাস, খুলনার চুকনগরের তপন দেবনাথ, ঢাকার সরল খাঁর শিষ্যরা যাত্রায় বিবেকের গান গেয়ে সুনাম অর্জন করবে। বিবেকের গানে জাতির বিবেকও জাগ্রত হবে। চারণ কবি মুকুন্দ দাশের গান লোকমুখে কারণে-অকারণে উচ্চারিত হবে।
জাপানের নো থিয়েটারের খবর রাখি। গ্লোব থিয়েটারে গিয়ে শেক্সপিয়ারের নাটক দেখি। তখন বরিশালে গিয়ে মনসার ভাসান দেখব। রাজশাহীতে আলকাব দেখব। তাই বলে শেক্সপিয়ার, ইবসেনকে ভুলব না। যাত্রামঞ্চে তখন মিলন কান্তি দে, অমলেন্দু বিশ্বাসের শিষ্যরা হ্যামলেট, ম্যাকবেথ করবেন। ডলস হাউজ, এনিমি অব দ্য পিপলস মঞ্চস্থ হবে গ্রামে, গ্রামে। শেঙপিয়ার, ইবসেনের দেশের লোকেরা অবাক হয়ে দেখবে, তাদের চাইতেও বেশি আন্তরিকতায় বাঙালির নাটমণ্ডলে মঞ্চস্থ হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ, ব্রেশট, মাইকেল, দীনবন্ধু মিত্র, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিমআলদীনের নাটক মঞ্চস্থ হবে। মুক্তধারা, রক্তকরবী, রাজা যাত্রামঞ্চে দেখতে গ্রামে গ্রামে ধুম পড়বে। তবে উন্মাদের মতো রবীন্দ্রচর্চায় মত্ত হবে না। রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্র নাটক মঞ্চায়নের জোয়ার দেখেছি। জোয়ারে বড় বেশি ভয়। বেনোজল ঢুকে যাওয়ার ভয়।
লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ হলে তারুণ্য যুগিপর্বের তাত্ত্বিকভিত্তি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, লোক ঐতিহ্য যাত্রার বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তর্কে লিপ্ত হয়ে রাত পার করে দেবে। শিব গাজনের গীত, নাট্যকবি আর লোকনাট্য আঙ্গিক সংক্রান্ত আলোচনায় সানন্দে অংশগ্রহণ করবে। দর্শক টিকেট কেটে এই আলোচনা শুনবে। নছিমন পালা, যুগীপর্ব, ভাসান যাত্রাসহ শতাধিক লোকপালার সংগ্রাহক কাজী সাইদ হোসেন দুলাল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিকদূত হিসাবে দেশ বিদেশে বক্তৃতা দেবেন। মানুষ টিকেট কেটে তাঁর কথা শুনবে। তাঁর শিষ্যরা রাজশাহীর পুঠিয়াতে ডেড়া বানিয়ে লোকসংস্কৃতির চর্চা করবে। তাঁদের সংগ্রহের তালিকা শতক ছাড়িয়ে যাবে।
লোক সংস্কৃতির সংগ্রহ এবং বিকাশে রবীন্দ্রনাথসহ অনেকে যুক্ত ছিলেন। দীনেশ চন্দ্র সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য্য, আশুতোষ চৌধুরী, আবদুল হক, রমেশ শীল, ফনী বড়ুয়া, ইসহাক চৌধুরী প্রমুখ লোকসংস্কৃতির অসীম ভান্ডারকে আমৃত্যু উন্মোচিত করেছেন। তাঁদের পথ ধরে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে যাবে। এ প্রজন্মের লোকগবেষকরা দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসংস্কৃতি পড়াবেন। তাঁদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহযোগিতা করবে।
গবেষকগণ লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ সূচিত করবেন আপন ঐতিহ্যের অঙ্গনে শুধু টিকে থাকার জন্য নয়, অনিশেষ চর্চার সম্ভাব্য উপায়ও বের করবেন। গবেষণার জন্য থাকবে সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা। এজন্য প্রধান ভূমিকায় থাকবে লোকসংস্কৃতি ইন্সটিটিউট। জেলায় থাকবে এর শাখা। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এই শাখা আদিবাসী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট নামে কার্যক্রম চালাবে। এর সঙ্গে গ্রাম থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, আইটিআইসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সম্পৃক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে লোকসংস্কৃতির সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং চর্চা অব্যাহত থাকবে। এভাবেও লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটবে। এতে বর্তমানের মতো সংমিশ্রণের মাধ্যমে চিরায়ত ধারার বিকৃতি ঘটবে না। আজকাল গ্রুপ থিয়েটারে মনসার ভাসান, লোকপালার নামে যা হচ্ছে, তা চিরায়ত ধারার পাশ্চাত্য সংস্করণ। বহির্বিশ্ব ঐটা দেখে বাংলার লোকসংস্কৃতির স্বাদ নিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম ঐ বিকৃতি জানছে। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণের ফলে এসব রহিত হবে।
নেতৃত্বের আসনে প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা অধিষ্টিত হলে লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটবেই। তারুণ্য এগিয়ে আসলে, সমষ্টির লোকসংস্কৃতি চর্চা হবে। আলোকিত মানুষ বাড়লে অষ্টক গানের শ্রোতা বৃদ্ধি পাবেই। বাংলাদেশে সমতাভিত্তিক রূপকল্প প্রণীত হলে বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে এদেশের অর্ধশতাধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রচার, প্রসার ঘটবে। লোকসংস্কৃতির নবজাগরণ একক জাতির আধিপত্যকে রহিত করে সমষ্টির প্রসার ঘটাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনাড়ম্বর উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধমহামারী মুক্ত হয়ে পৃথিবী আবার মুখরিত হোক উৎসবে