ভারতের লোকসভা নির্বাচন শেষ হলো। জয় হলো অনেকটা খর্ব করে দেয়া গণতন্ত্রের। মোদি এখন জয়ী হয়েও পরাজিতের গ্লানিতে ভুগছেন আর বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট পরাজিত হয়েও জয়ের আনন্দ উপভোগ করছে। চরম কর্তৃত্ববাদ, নির্বাচন কমিশনের নজির বিহীন পক্ষপাতিত্ব, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলো দিয়ে বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের কারণে অকারণে প্রচণ্ড হয়রানি সহ নানা অপচেষ্টা চালিয়ে মোদি সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে চারশ আসনের টার্গেট নিয়ে একতরফা বিজয় অর্জন করতে চেয়েছে। কিন্তু এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বিরোধীদলগুলো বিজেপিকে সে সুযোগ দেয়নি। সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় আসনও বিজেপি লাভ করেনি। নির্বাচিত স্বৈরশাসক মোদিকে এখন একটা অস্থিতিশীল কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হচ্ছে। বামেরা সারা ভারতে দশটির মত আসন লাভ করেছে। তীব্র নির্বাচনী লড়াই করেও পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূলের ব্যাপক রিগিং, সরাসরি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কারণে পশ্চিমবঙ্গে এবারও বামেরা কোন আসন পায়নি এমনকি একই কারণে অধীর চৌধুরীর মত পাঁচবারে কংগ্রেস সাংসদ পরাজিত হয়েছেন। কমরেড সেলিম সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। মমতা এবং মোদির কারণে পশ্চিমবঙ্গ এখন ভারতে সাম্প্রদায়িকভাবে সবচেয়ে বিভাজিত একটি রাজ্যে পরিণত হয়েছে। মমতা সেই বিভক্তির সুযোগ সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে। বিজেপির সাবেক কেন্দ্রিয় মন্ত্রী মমতার উদ্যোগে ও সমর্থনে ১৯৯৯ সালে লোকসভার নির্বাচনে সেবার দমদম আসন থেকে প্রথমবারের মতো বিজেপি নেতা তপন সিকদার জয়ী হয়। এ ভাবেই বিজেপি মমতার হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রবেশ করে।
১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে ভূমি সংস্কার, শিক্ষা জাতীয়করণ, পঞ্চায়েতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করে দশ বছরের মধ্যে কৃষি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পশ্চিম বাংলার গ্রাম গুলোর চেহারায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে বাম ফ্রন্ট। গ্রাম বাংলা তাদের দূর্গে পরিণত হয় কিন্তু পরবর্তীতে সমাজ ও অর্থনীতির স্থবিরতার মুখে শিল্প উন্নয়নে হাত দেয়। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের শাসনের কারণে কিছুটা গণবিচ্ছিন্ন, নেতাদের আত্মসন্তুষ্টি, পঞ্চায়েত ও ব্লক পর্যায়ে নেতাকর্মীদের আত্মম্ভরিতা, অসদাচরণ, তসলিমা নাসরিন ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে মৌলবাদী সংখ্যালঘুদের সহিংসতা, সর্বোপরি শিল্পের জন্য নন্দীগ্রাম নিয়ে অপপ্রচারকে অবমূল্যায়ন করে প্রথম থেকেই কঠোর না হওয়াসহ দেশি বিদেশী চক্রান্তে ২০০৯ সাল থেকে বাম ফ্রন্টের সমর্থন কমতে থাকে এবং মানুষের মধ্যে একধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এতে শামিল হন অপরিণামদর্শী কিছু বুদ্ধিজীবী। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও কংগ্রেস তৃণমূল জোটের কাছে পরাজিত হয়। ক্ষমতায় এসেই সারা পশ্চিমবঙ্গে বাম নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মমতা নজিরবিহীন শ্বেত সন্ত্রাস শুরু করে। সর্বত্রই বামদের দলীয় দপ্তর গুলো উচ্ছেদ বা বন্ধ করে দেয়া হয়। হাজার হাজার কর্মীদের হয় জেলে নয়তো এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কয়েক শত কর্মীকে হত্যা করা হয়। এই সুযোগে মমতার আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে ও কেন্দ্রের সহযোগিতায় বামদের বিকল্প হিসাবে চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তার সাংগঠনিক তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে ভোটের জন্য মমতা মুসলিম মৌলবাদকে দৃষ্টিকটুভাবে তোষণ করা শুরু করে যা এমনকি প্রগতিশীল, কল্যাণকামী মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ক্ষুব্ধ করে তুলে এবং এর ভবিষ্যত বিরূপ পরিণতির কথা ভেবে তারা তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি পর্যন্ত প্রদান করেন। বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল কিন্তু মমতার অন্যায় প্রশ্রয়ে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ফলে সন্দেশখালির শাহাজাহান শেখের মত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কিছু দুর্বৃত্তের আবির্ভাব হয় যা হিন্দু মুসলিম সম্পর্ককে কলুষিত করতে, অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে, হিন্দুত্ববাদ প্রচারে বিজেপিকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। অন্যদিকে তৃণমূলের দ্বারা চরমভাবে নির্যাতিত এমনকি গৃহহীন হয়ে গ্রাম বাংলার অগণিত সাধারণ বাম কর্মী–সমর্থক নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল হিসাবে বিজেপিকে সমর্থন করতে শুরু করে কেন না তখনো বাম শক্তি গ্রামে গঞ্জে মমতার আক্রমণ মোকাবেলা করে সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি ক্রমাগত হামলার মুখে। এবার নির্যাতিত কমী–সমর্থকদের কিছু ভোট বামদের পক্ষে চলে আসাতেই বিজেপির আসন কমে গেছে।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে লাগাতার প্রচেষ্টায় মমতার ভাষায় নিঃশেষ করে দেয়া বামেরা বিভাজিত পরিবেশে সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে জেনেও মানুষকে সচেতন করার জন্য সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠিত হয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে এবার পূর্ণশক্তি নিয়ে নেমেছে। সিপিআই (এম) বিনাদ্বিধায় প্রবীণ নেতৃত্বের জায়গায় এবার পশ্চিম বাংলায় একটি নবীন প্রজন্মকে নেতৃত্বে নিয়ে এসেছে। কোনও ব্যক্তি ইমেজ বা একক নেতৃত্বে দুই লক্ষেরও বেশি সদস্যের বিরাট এই পার্টি চলছে না, চলছে যৌথ নেতৃত্বে, সম্মত সিদ্ধান্ত। কমরেড বিমান বসু, সূর্য কান্ত মিশ্র, মোহাম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীর মত প্রবীণদের উৎসাহে নেতৃত্বে এসে গেছে এবং কমরেড মিনাক্ষী, দীপ্সিতা, পরমবত, ঐষী, সৃজন, প্রতীকউর রহমান প্রমুখ তরুণ নেতারা ইতোমধ্যে পার্টির মুখ হয়ে সারা পশ্চিম বাংলায় মাঠে–ময়দানে, সমাবেশ–মিছিলে বক্তব্যের ঝাঁজে–ঋজুতায় মানুষের কাছে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। যে কংগ্রেস বিরোধিতা ছিল সিপিআই(এম) এর রাজনীতির আজন্ম স্লোগান, যে কংগ্রেসের কারণে ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়, কেরলে বামফ্রন্টের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো যেখানে কংগ্রেস পরিস্থিতির নির্মোহ বিবেচনায়, সংকীর্ণ ছুৎমার্গ এড়িয়ে বৃহত্তর প্রয়োজনে, কংগ্রেসের সাথে জোট করেছে সুবিধাবাদী, বিজেপিরই একসময়ের জোট সঙ্গী, কট্টর কমিউনিষ্ট বিরোধী, প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক, পশ্চিম বঙ্গের প্রগতিশীল সমাজ মানসকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত করে দেয়া ও বিজেপি’র মত চরম সাম্প্রদায়িক দলকে বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক স্পেস ও সুবিধা দেওয়া মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিপ্লবী কর্তব্য বোধ থেকে। আগামী দিনের পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে অনুপেক্ষণীয় এই শক্তি প্রভাবকের ভূমিকা যে পালন করবে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শাসক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা, জবরদস্তি, লুটপাটসহ দুই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শক্তির প্রায় সমধর্মী বৈশিষ্ট্যের কারণে কিছু মৌলিক বিষয়ে প্রতিবেশী রাজ্যের রাজনীতি থেকে এ দেশের বাম প্রগতিশীলদের শিক্ষা নেয়া আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। আমি মনে করি আমাদের দেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান সংকট প্রগতিশীল বাম রাজনীতির বহুধা বিভক্তি শুধু নয় বিদ্যমান দলগুলোর অভ্যন্তরে শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, আমিত্ব এবং আন্তরিকতার অবলুপ্তি। এজন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মতৈক্য থাকা সত্ত্বেও দলগুলোর মধ্যে ভাঙ্গন ও বিভক্তি চলছে। ওয়াকার্স পাটি, বাসদ প্রভৃতির বহুধা বিভক্তি এ কথাই প্রমাণ করে। অথচ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সি পি আই (এম) এর নেতৃত্ব সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে যে নজিরবিহীন কঠিন সংকটে পড়েছিল সে সংকট তারা মোকাবেলা করেছে কমিউনিস্ট কালচার মেনে। পশ্চিমবঙ্গের মত গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাঞ্চলীয় একটি রাজ্যের রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করে জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপে তথা তার সাম্প্রদায়িক লুটেরা ধারাকে দুর্বল করে ভারতীয় রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে রাজ্যে রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে তীব্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের বাম শক্তিগুলোর লড়াই এর ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য (range and variety) অনেক কম। কিন্তু এখানে বামেদের অন্তর্গত কোন্দল, পেটিবুর্জোয়া সুবিধাবাদ, বিশুদ্ধবাদী স্লোগানের আড়ালে নেতাদের নিজস্ব বলয় তৈরির অপচেষ্টা, এই সব কারণে তারা এগুতে পারছেনা। এদেশে অন্ধ সাম্প্রদায়িক সামাজিক মতস্তত্ত্ব, গণতন্ত্রহীনতা, অর্থনীতিতে লুটেরাদের একাধিপত্য ও জনজীবনের দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক গণসংগঠনের নিজস্ব শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়া বিরাজমান সংকট থেকে উত্তরণের যে সহজ কোনও বিকল্প পথ নেই এটা সবাই বলে কিন্তু আন্দোলনের হাতিয়ার গণসংগঠনগুলোকে তারা বিভক্ত করে রেখেছে এবং গণসংগঠনের গণচরিত্র পাল্টে পেশাগত দাবীর চাইতেও কথিত রাজনৈতিক আদর্শ গণসংগঠনগুলোর কাছে মুখ্য করে তুলেছে। এদেশে বামরা দুই বৃহৎ দলের সমালোচনা করে কিন্তু নিজেদের দলের ক্রমবর্ধমান বিভক্তি, অবক্ষয়ী আভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলে না। ইতিহাস সাক্ষী বাম–কমিউনিস্টদের ছাত্র–শ্রমিক গণসংগঠনগুলোর শক্তিই মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে আওয়ামী লীগ সহ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে দৃঢভাবে প্রগতির পথে পরিচালিত করেছিল।
সোভিয়েতের ভাঙনের পর গত ৩০ বছর সঠিকভাবেই কোন কোন বাম দল নিজেদের অভ্যন্তরে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে এবং এখন কারো সাথে কারো একটু দ্বিমত হলেই বিলোপবাদীর তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এদিকে নিজেরাই নিজেদের হাত–পা কেটে অর্থাৎ গণসংগঠনগুলোকে টুকরো টুকরো করে নিজেদের ক্রমে দুর্বল ও প্রকৃত অর্থে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে লেনিনীয় শিক্ষার বিপরীতে। এরা নিজেদের মধ্যে ‘কমরেড ইন আর্মস’ এর বদলে ক্রমে ‘কমরেড ইন কনটেস্ট’ এর জায়গায় চলে যাচ্ছে। যে কনটেস্ট হবে শ্রেণি শক্রর বিরুদ্ধে সেই কনটেস্ট রণকৌশল ও মতাদর্শগত ভাবে সমিল সহকর্মী ও সহমর্মীদের মধ্যে চলেছে। এভাবে এক সীমিত গোলকধাঁধায় আটকে যাচ্ছে এ দেশের বাম আন্দোলনের গতি প্রকৃতি। অথচ পশ্চিমবঙ্গে বামেরা কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন দুই হিংস্র, দাপুটে শক্তির বিরুদ্ধে সমানে লড়ে চলেছে। সেই লড়াইয়ে ঐক্য ও সংগ্রামের এই দ্বৈরথে ও দ্বান্দ্বিক পরিবেশে বামেরা বিভিন্ন রাজ্যে মূর্ত পরিস্থিতিতে মূর্ত বিবেচনায় লড়ে চলেছে। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট শক্তির সাথে দেশব্যাপী বিশাল লড়াইয়ে বামেদের ধৈর্য্য ও বিচিত্র রণকৌশল, নেতৃত্বের প্রকৃত আন্তরিকতা, কমিটমেন্ট এসব কিছু থেকে এদেশের বাম প্রগতিশীলদের জানা, বোঝা ও শেখার প্রভূত বিপ্লবী উপাদান রয়েছে। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে এই মুহূর্তে এ দেশের প্রধান রাজনৈতিক সংকট কী – নির্দ্বিধায় উত্তর হবে বামদলগুলোর সব বিষয়ে সাবজেক্টটিভ বিবেচনা, পারস্পরিক ও আভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস ও বিভক্তি। এই রুক্ষ রক্ষণশীল মানসিকতার বিপরীতে বাম ও গণতান্ত্রিক নেতা কর্মীদের রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলব ‘সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন সহজ হবি’। সমাজ পরিবর্তনের অনিবার্য সত্য ও প্রত্যয় থেকে হেমিংওয়ের কথা একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই Lefts are not meant for defeat.
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট।