পলি জমে চেঙ্গী এখন মরা নদী

৪০ ফুটের গভীরতা কমে এখন ১৫ ফুট, শুষ্ক মৌসুমে বন্ধ থাকে নৌ চলাচল

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | বৃহস্পতিবার , ৩ জুন, ২০২১ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ি প্রধান নদী চেঙ্গী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এর উৎপত্তি। রাজ্যটির আঠারমুড়া থেকে শুরু হয়ে দীর্ঘ ৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এটি মহালছড়িতে এসে কাপ্তাই লেকে মিলিত হয়েছে। এই নদীর অববাহিকায় রয়েছে লোগং, পানছড়ি, ভাইবোনছড়া, খাগড়াছড়ি, মাইসছড়ি ও মহালছড়ি। কথিত আছে, ত্রিপুরা মহারাজের চেঙ্গী নামে এক সেনাপতি ছিলেন। তিনি জনৈক বিধবা রমণীর প্রেমে পড়েন। পরে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ওই সেনাপতি এই নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে এটি চেঙ্গী নদী নামে পরিচিত হয়ে উঠে। সেনাপতি চেঙ্গী যেখানে বসবাস করতেন সেই স্থানটি এখনো চেঙ্গী পাড়া এবং চেঙ্গী মৌজা হিসেবে পরিচিত।
ভরা নদী এখন মরা : এক সময়ের ভরা যৌবন ছিল চেঙ্গীর। জেলার বিভিন্ন পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রায় ২৫০টি ছড়া মিলিত হয়েছে এই নদীর স্রোতে। অতীতে এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি হয়ে রাঙামাটি পর্যন্ত নিয়মিত নৌপথে ছিল যাতায়াত। নদীর গভীরতা ছিল প্রায় ৪০ ফুট। কিন্তু এখন ১৫ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় বন্ধ থাকে নৌ চলাচল। বলতে গেলে এটি এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।
১৯৮২ সাল থেকে মহালছড়িতে বসবাস করছেন জনৈক ফরিদ মিয়া ও জসীম উদ্দিন। তারা জানান, একসময় নদীর গভীরতা ছিল ৪০ ফুট। এখন আছে মাত্র ১৫ ফুট। বর্ষাকালে নৌ যাতায়াত স্বাভাবিক থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। ফলে নাব্যতা কমে যাওয়ায় বর্ষায় বৃষ্টির পানি নদী উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়।
যেভাবে ভরাট হচ্ছে চেঙ্গী : সময়ের পরিক্রমায় পলি জমে চেঙ্গী নাব্যতা হারাচ্ছে। পাহাড় কর্তন ও জুম চাষের কারণে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বালু, মাটি আর ময়লায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। জেগে উঠেছে চর। প্রতিবছর এভাবে চলতে থাকলেও এটি খননের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
বর্ষায় চেঙ্গীর ভয়াল রূপ : শুষ্ক মৌসুমে নদীটি মরা থাকলেও বর্ষায় শুরু হয় তীব্র স্রোত। কিন্তু নদী খনন ও ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় বর্ষা আসলেই আতঙ্ক শুরু হয়। পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে চেঙ্গীর দুকূল বন্যায় প্লাবিত হয়। প্রতিবছরই বর্ষায় খাগড়াছড়ি শহর, নিচের বাজার, খবংপুড়িয়া, গঞ্জপাড়া, শান্তিনগর, মুসলিমপাড়া, পানছড়ি, মাইসছড়ি ও মহালছড়ির অর্ধশতাধিক গ্রাম একাধিকবার বন্যায় তলিয়ে যায়। স্থানীয়রা জানান, নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির প্রবাহ কমে যায়। এতে সহসা নদীর তীরের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। বছরের পর বছর নদীর কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হলেও তা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
নদী ড্রেজিংয়ের দাবি : স্থানীয়দের দাবি, চেঙ্গী নদী এখনো পর্যন্ত কোনো সময় ড্রেজিং করা হয়নি। কৃষকরা জানান, একসময় এই নদী থেকে পাম্প মেশিনের মাধ্যমে সেচ দেয়া যেত। কিন্ত বর্তমানে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তাই সনাতনী পদ্ধতিতে সেচ কার্যক্রম চালাতে হয়। এছাড়া নাব্যতা সংকটের কারণে বিপাকে পড়েছেন মৎসজীবীরাও। নদীতে মাছ না থাকায় এর উপর নির্ভরশীল মহালছড়ির প্রায় ১২শ জেলে পরিবারে দেখা দিয়ে চরম দুর্দশা।
পরিবেশবাদীদের দাবি : খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনে সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী জানান, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও পাহাড়ি নদীগুলো রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখানে সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি নৌ চলাচলেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। ফলে এটি দ্রুত ড্রেজিং করা প্রয়োজন।
যা বলছে পাউবো : খাগড়াছড়ি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (অ.দ) নুরুল আফসার বলেন, চেঙ্গী ও মাইনী নদীর উপর জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। এই দুই নদীকে পূর্বের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে খাগড়াছড়ির দিঘীনালার পাশাপাশি রাঙামাটির নানিয়ার চর হয়ে মহালছড়ি, দাঁতকুপিয়া, কমলছড়ি হয়ে নদী খনন, চর কাটিং ও একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করার জন্য প্রায় ৬৪০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলমান মহামারী নিয়ন্ত্রণে এলে তা শুরু হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফ্লাইট নিষেধাজ্ঞায় যুক্ত হলো নতুন ৭ দেশ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬