পলিথিন প্লাস্টিকেরই পরিবর্তিত রূপ। সকল পলিথিনই প্লাস্টিক কিন্তু সকল প্লাস্টিক পলিথিন নয়। এগুলো মূলত অপচনশীল পদার্থ দিয়ে তৈরি। সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৮১ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হচ্ছে এর মধ্যে ৪৫ কোটি টন বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে যার ৫১% উৎপাদিত হচ্ছে এশিয়া মহাদেশে। চীন উৎপাদন ও দূষণে প্রথম এবং বাংলাদেশ আছে দশম স্থানে।
প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যারিব্যাগ বা পলিব্যাগ। হিসাব মতে, গড়ে জনপ্রতি বছরে ব্যাগ বানানো হচ্ছে ৭০০টি এবং ১টি ব্যাগ গড়ে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট ব্যবহারের পরেই প্রকৃতিতে স্থান নেয়। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। ছোট বড় কারখানার সংখ্যাও প্রায় তিন হাজার। এসব কারখানায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর।
এই দীর্ঘ সময় ধরে এরা পরিবেশে অবস্থান করে মাটি ও পানির মধ্যে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদের গ্রহণে ও চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের কণা পানীয় জলের মাধ্যমে প্রাণীর খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা (২০২২) তিন–চতুর্থাংশ পশুর মাংসে, দুগ্ধজাত পণ্যে ও রক্তে, পশুর খাদ্যে, মানুষের রক্তে (প্রায় ৮০%) এবং বয়স্ক ও শিশুদের মলে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা সনাক্ত করেছেন। আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, মানবদেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গে, রক্তের প্রবাহে ও ধমনীতে আটকে থাকা প্লাকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছেন (বিডিনিউ২৪ডটকম, সেপ্টেম্বর ২০২৪)। অন্যদিকে মৃত মানবদেহের মস্তিষ্কের টিস্যুতে মাইক্রো প্লাস্টিকের কণা পাওয়ার দাবি করেছেন ব্রাজিলের বিজ্ঞানীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের এক গবেষক দল বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে পাওয়া ১৫ প্রজাতির দেশি মাছের ৭৩.৩ শতাংশ নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন। তাছাড়া সিগারেটের ফিল্টারেও মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।
অন্যদিকে, প্লাস্টিক পণ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের বসবাসযোগ্য শহরগুলোর অলিগলি, ড্রেন, নালা, নর্দমা ও খালে অবস্থান করে, ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরগুলোতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।
উক্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে এবং ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করার কথা জানিয়েছেন, যা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিকল্প হিসেবে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।
আমার সংশয় হলো পলিথিন ব্যাগ বন্ধের পাশাপাশি পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ বন্ধের নির্দেশনা নিয়ে। পলিপ্রপাইলিনকে বাদ দিয়ে বর্তমান যুগের মানুষের জীবন যাপন কল্পনাতীত, কারণ তার ব্যবহার সর্বত্র এবং পরিসরও অনেক বড়। উদাহরণস্বরূপ কৃষি পণ্য, যেমন ফিড, ফল, শাকসবজি, তরল জাতীয় পণ্য ইত্যাদি সংরক্ষণ এবং পরিবহনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই ব্যাগগুলি ভুট্টা, চাল, ময়দা, রাসায়নিক সার এবং অন্যান্য খাবার প্যাক করার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে এই ব্যাগগুলি অ–বিষাক্ত, তাই খাদ্যদ্রব্য দূষিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এছাড়াও, তারা অ্যান্টি–সিপেজ, তাই লবণ, চিনি, সিমেন্ট এবং আটার মতো আইটেমগুলি পরিবহনের সময় ব্যাগের ছিদ্র দিয়ে পড়ে যেতে পারে না বা বাহির থেকে পানিও ঢুকতে পারে না। আশা করি, সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা মহোদয় বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
বাংলাদেশে যেহেতু বিপজ্জনক হারে প্লাস্টিক দূষণ বেড়েছে, তাই তার একটা টেকসই ব্যবস্থাপনা দরকার–যেমন:
১। বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা। তাছাড়া জাপানের মত দীর্ঘস্থায়ী ইকো ব্যাগের ব্যবহার চালু করা যেতে পারে যেগুলো ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন উপাদান (তুলা, পাট ইত্যাদি) দিয়ে তৈরি। ২। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহার কমানো, পুনঃব্যবহার, পুনরায় ব্যবহারের উপাযোগী করে তোলা। এ তিন কৌশল অবলম্বন করা। ৩। গার্মেন্টস প্রোডাক্ট এবং মৎস্য রপ্তানির কাজে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহৃত হয়। তাদেরকে বিবেচনায় রেখে ক্রমান্বয়ে প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানাগুলো বন্ধ করা। ৪। যারা চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ, কাঁচা বাজার, ও শপিংমলে নিজস্ব কাপ, পানির বোতল, শপিং ব্যাগ নিয়ে আসবে তাদের জন্য মূল্য ছাড়ের উদ্যোগ নেয়া, তাতে করে আমাদের মধ্যে পুনর্ব্যবহার করার মানসিকতা তৈরি হবে। ৫। আবাসিক ভবন, হোটেল ও রেস্তোরাঁর বর্জ্য সংগ্রহের জন্য তাইওয়ানের ‘পে–অ্যাস–ইউ–থ্রো” মডেল – চালু করে প্লাস্টিক বর্জ্য রোধ করা যেতে পারে। ৬। বিকল্প হিসাবে বিভিন্ন ঘনত্ব ও সাইজের পি ই শপিং ব্যাগ (পুন ব্যবহারযোগ্য) দোকানে রাখা যেতে পারে, যার মূল্য ক্রেতারা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই শপিং ব্যাগের জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হয় যা আমাদের দেশে পরোক্ষ ধূমপানের মত বিনামূল্যে পাওয়া যায়। ৭। প্লাস্টিক দূষণ নির্মল করার উত্তম পদ্ধতি হলো রিসাইক্লিং। এই পদ্ধতিতে বর্জ্য পলিথিন থেকে তেল উৎপাদনে আগ্রহী উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করা এবং তাদের উৎপাদিত তেল ক্রেতাদের মধ্যে সরাসরি বিক্রয়ের অনুমতি প্রদান করা। ৮। বিভিন্ন সভা–সমিতি, পত্র–পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা।
সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পলিথিন বন্ধের এই মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হোক।
লেখক: অধ্যাপক, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।