পলিথিন ও প্লাস্টিক দৈনন্দিন কাজে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য হিসেবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা জানি না –এই পলিথিন কতটা ভয়ংকর! কতটা ক্ষতি করছে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের। পলিথিন এমন একটি পদার্থ যা পচন অযোগ্য। এমনকি পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড কার্বন মনোঅক্সাইড উৎপন্ন করে বায়ু দূষণ করে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান রয়েছে। তবু পলিথিনের ব্যবহার থামছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিনের ব্যাগ জমা হচ্ছে। অন্য এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি করে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিনের ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার মতো চট্টগ্রামে এবং অন্যান্য শহরেও পলিথিনের ব্যবহারে উদ্বিগ্ন পরিবেশকর্মীরা। গবেষকরা বলছেন, বর্তমানের পলিথিন দূষণের মাত্রা বজায় থাকলে ২০৫০ নাগাদ সাগরে মাছের চাইতে পলিথিনের খণ্ডিত অংশের সংখ্যা বেশি হবে। বিষয়টি কতটা উদ্বেগের তা আমরা হয়তো অনেকেই অনুমান করতে পারছি না।
এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন চট্টগ্রামকে পলিথিনমুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই লক্ষ্যে গত ৩১ মে সার্কিট হাউসে এ সংক্রান্ত একটি মতবিনিময় সভায় ১২ টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে : পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সেজন্য পাটজাত পণ্যের উৎপাদন, ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে; পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পাঠ্য পুস্তকে লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গোচরে আনতে হবে; স্কুল–কলেজ পর্যায়ে কর্মশালার আয়োজন করে ছাত্র–ছাত্রীকে সচেতন করতে হবে; পলিথিন বিক্রি, ব্যবহার বন্ধের নিমিত্তে এবং ভোক্তা পর্যায়ে সচেতন করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা, সেমিনারের আয়োজন পূর্বক কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; পলিথিন তৈরির কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে; পলিথিনের বিকল্প পণ্য হিসেবে পচনশীল পাটজাত, কাগজের অথবা কাপড়ের পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে; পলিথিনের বিকল্প পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাকে এগিয়ে আসতে হবে; উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সহজলভ্য করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; আইনের ব্যবহার (যার কাছে পলিথিন ব্যগ থাকবে তার উপর) যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এনডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। আগামী ১ জুলাই পলিথিন ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কার্যকরী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সভায় অবহিত করা হয়।
আমরা প্রত্যক্ষ করি, যেখানে সেখানে পড়ে আছে পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ। ময়লা–আবর্জনা ফেলার জন্যও পলিথিন ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মাটিতে পলিথিন আটকে পানি ও প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান চলাচলে বাধা দেয়। মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না, জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং শস্যের ফলন কম হয়। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে নালায় ঢুকে পড়ে, যে কারণে হালকা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম নগরীর সবগুলো বাজারকে পলিথিন মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি নগরীর বাজারগুলোতে মাইকিং, পোস্টার, ফ্যাস্টুন, ব্যানার ও লিফলেটসহ পলিথিন বন্ধে সকল ধরনের প্রচার প্রচারণা চালাতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, পলিথিনের কারণে নগরের জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পলিথিনের কারণে নালা–নর্দমায় পানি জমে মশার প্রজনন অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো পলিথিনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে জমাট হয়ে ৮ ফুটের বেশি শক্ত স্তর তৈরি করেছে। যা কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং করতে গিয়ে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। কিন্তু সিটি মেয়রের উদ্যোগ বেশি দূর আর এগোয়নি।
এবার ‘পলিথিন মুক্ত চট্টগ্রাম’ বাস্তবায়নে যে ১২টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে পলিথিন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং পলিথিনের বিকল্প পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাকে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে হবে।