পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় এসব কথা বলেন তিনি। এ কাজে তরুণ বা শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানান পরিবেশ উপদেষ্টা। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ১ অক্টোবরের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হবে। পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে ‘পলিথিন থামাতে বন্ধ করতে হবে কারখানা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গতকাল ১১ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে প্রতি মাসে গড়ে বিশ কোটি পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান চালানো হলেও পলিথিনের অবাধ বিকিকিনি বন্ধ হচ্ছে না। এর মাঝে শুধু সুপারশপে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন লাখ লাখ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ২০ ফুটের বেশি উচ্চতার পলিথিনের স্তর গড়ে ওঠার পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকাও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে জোয়ারের পানিতে নগরী প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন এবং বাজারজাত অব্যাহত রেখে দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে। সুপারশপে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সুফল আসবে না বলে মন্তব্য করে দেশে পলিথিনের উৎপাদন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। তাদের মতে, কারখানা চালু বা উৎপাদন অব্যাহত রেখে ব্যবহার বন্ধ করা কোনোদিন সম্ভব হবে না। পলিথিনের বিকল্প পাটজাত ব্যাগ বা পচনশীল পলিথিন উৎপাদনে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিলে সুফল মিলবে।
পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার যেমন শেষ নেই, তেমনিভাবে প্রচার–প্রচারণা ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পলিথিন পরিবেশ সুরক্ষার জন্য চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের দেশে দিন দিন পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। আশির দশকে প্রথম দেশের বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। এখন পাইকারি বিক্রয়সহ প্রায় সব হাটবাজারেই অবাধে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য ও এর দাম কম হওয়ায় দোকানিরাও যথেচ্ছভাবে সেগুলো ব্যবহার করে চলেছেন। একবার ব্যবহারের পর সেগুলো যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর–মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের নালা–নর্দমা। ভেঙে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যের কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল–বিল–নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। পলিথিন খাল–বিল, নদী–নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী।
পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। পলিথিন মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচেও তা পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, মাটির গুণগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নিচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম আঙিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনসাধারণ সচেতন হলেই কমানো যায় পলিথিনের ব্যবহার, রক্ষা পায় আমাদের পরিবেশ ও শত শত মানুষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে ২০০২ সালে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’–এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারগুলোয় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। তাই আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর পরিবেশ উপহার দিতে পলিথিনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বাজারে পলিথিন বন্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালাতে হবে। কারখানার মালিকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।