স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশ এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দেশের বিজ্ঞানীরাও নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। তেমনই একটি পণ্য পাট থেকে উৎপাদিত সোনালী ব্যাগ, যেটি পলিথিনের বিকল্প। ২০১৬সালে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ খান এটি আবিষ্কার করেন। যা বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার আগেই দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলে। এই ব্যাগটির বিশেষত্ব হলো এটি পচনশীল ও পরিবেশ বান্ধব। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে পাইলট প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এতে শুধু ব্যাগের সীমিত উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনো পণ্যটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি। অথচ বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিনে। কাঁচাবাজার, মুদিদোকান, শপিংমল, চেইনশপ সব জায়গায় পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝে মাঝে অভিযানও চালানো হয়, কিন্তু এর ব্যবহার কমেনি। বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। পরিবেশবিদেরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার কারণেই দেশ পলিথিন থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বর্তমানে পলিথিন নিয়ে সারা বিশ্ব চিন্তিত। প্রতিদিন বিশ্বে লাখ লাখ টন পলিব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে যা বর্জ্য হিসেবে পরিবেশ দূষণ করছে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ২০ বছর ধরে পলিথিন দূষণ নিয়ে চিন্তিত। ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারাদেশে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এর বিকল্প নিয়ে কখনো সিরিয়াসলি ভাবা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের জন্যই ক্ষতিকর পলিথিনের নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসাবে ভাবা হচ্ছে পাটের তৈরি পচনশীল সোনালি ব্যাগকে।
ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে সরকারি লতিফ বাওয়ানী জুট মিল, সোনালি ব্যাগ তৈরির কারখানা। সরকার ২০১৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়। বর্তমানে প্রতি দিন হাজার খানেক সোনালি ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিটি ব্যাগ ১০ টাকা দামে মতিঝিলে অবস্থিত বিজেএমসির কার্যালয়ে বিক্রি করা হয়। তবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পণ্যটির খুব দ্রুতই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব। পণ্যটির উদ্ভাবক বলেছেন, সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে আরও ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। তিনি এখন বড় আকারের সরকারি বরাদ্দ চান, পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাও খুঁজছেন। ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টন পাটের ব্যাগ উৎপাদন সম্ভব।এই বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসতে দুই থেকে তিন বছরের বেশি সময় লাগবে না উল্লেখ করে ড. মোবারক বলেন, ছোট পরিসরে উৎপাদন করেও ১০ হাজার ব্যাগ বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতি টন পাটে এক লাখ ব্যাগ হয়। প্রতিটি ব্যাগে সাত থেকে আট টাকা খরচ হয় আর বিক্রি হয় ১০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিক ভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আসার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) ব্যাগ সিলিং মেশিন কেনা ও বড় আকারের অর্থায়ন। এই বিষয়ে ড. মোবারক বলেন, পাইলট প্রকল্পের টার্গেট ছিল দৈনিক এক লাখ ব্যাগ উৎপাদন করা।কিন্তু তা সম্ভব হয়নি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ব্যাগ সিলিং মেশিনের অভাবে।এখন ২৪ ঘণ্টা যন্ত্র চালিয়ে ৯০ হাজার ব্যাগ উৎপাদন করা যায়। তিনি বলেন,স্থানীয় উদ্যোক্তারা যদি বিনিয়োগ করেন, তাহলে এটা দ্রুত বাণিজ্যিক আকারে করা সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেন, দৈনিক ১০ টন উৎপাদন করতে হলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
তবে আশার কথা হলো পাট থেকে উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগের সম্ভাবনা নিয়ে সমপ্রতি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে জাপানের বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠী মারুবেনি। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বলে জানা গেছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইউরোপের দেশগুলোরও বিপুল আগ্রহ রয়েছে দেশের সোনালি ব্যাগে বিনিয়োগে। ইতিমধ্যে এই ব্যাগ তৈরিতে যুক্তরাজ্যের ফুটামুরা কেমিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে সব ধরনের মেশিনারিজ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। বিজেএমসির আশা, আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবে।
অন্যদিকে বেসরকারি উদ্যোগে জাপানে ১০০ কেজি সোনালি ব্যাগ রপ্তানি হয়েছে। বিজ্ঞানী ড. মোবারক খান বলেন, পলিথিনের তুলনায় পাটের পলিমার দেড় গুণ বেশি ভার বহন করতে পারে। এটি পানি শোষণ না করলেও ফেলে দেওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।দেশে-বিদেশে অনেক উদ্যোক্তা এটি নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এদিকে ইউরোপসহ বিশ্বের ৭২টি দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। এরপরও প্লাস্টিকের সহজ বিকল্প না থাকায় ইউরোপে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রযুক্তি হস্তান্তরে তার কোনো বাধা নেই।তিনি আরো বলেন, রিসাইকল করা যায় বলে তিনটি ব্যাগ ফেরত দিলে একটি ব্যাগ বিনামূল্যে দেওয়া যাবে। ১০ টাকার একটি ব্যাগ বিশ্ববাজারে মাত্র ১০ সেন্টে বিক্রি করা যাবে। অন্যদিকে ইউরোপের বাজারে এখনো একটি পলিব্যাগ কিনতে ২০ সেন্ট লাগে। তবে তিনি আশা করেন এই প্রকল্প বাস্তবায়নে শিগগিরই একটি শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হবে।অন্য দিকে সোনালি ব্যাগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে দেশের ব্যবসায়িরা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো চার হাজার ৮০০ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করে। চলতি বছর থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় সোনালি ব্যাগের বিনিয়োগ করা গেলে দেশের পাটশিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তা হলো বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং।
পলিথিনের বিকল্প হওয়ায় সোনালি ব্যাগ যে বিশ্ববাজারে আলোড়ন তুলবে,তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্য দেশগুলো চাইলেও এই ব্যাগ সহজে বানাতে পারবে না,কারণ কাঁচামাল হিসেবে যে পাট দরকার তার প্রধান উৎস হলো বাংলাদেশ। ফলে এই ব্যাগের প্রধান উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশই এই কৃতিত্বের ভাগীদার হবে। এই পণ্যের গায়ে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। সেজন্য এই খাতকে এখনই সরকারের অগ্রাধিকারে আনা দরকার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেই প্রত্যাশায় থাকলাম। লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক