চিটাগাং উইমেন চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ–এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন,পর্যটন শিল্পের প্রতিটি সেক্টরে নারীর সম্পৃক্ততা অনস্বীকার্য। অথচ এই শিল্পে নারীর এই সম্পৃক্ততা এখনো দৃশ্যমান নয়। বিষয়টি কোনোদিনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেনি। এ পর্যন্ত এই বিষয় নিয়ে কেউ ভাবেনওনি। এখন সময় এসেছে এই বিষয়টিকে আলোচনার আওতায় এনে নারীদের কর্মক্ষমতা আর দক্ষতাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নারীদের মতো যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার। মূলত পর্যটন শিল্প হলো এমন এক অর্থনৈতিক সেক্টর,রযা পর্যটকদের সেবাপ্রদান করে থাকে। এসব সেবার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভ্রমণ,আবাসন,খাবার–দাবার,পরিবহন, বিনোদন সহ অন্যান্য সুবিধা। এই শিল্প একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে, অন্যদিকে মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন উন্নত করতে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই শিল্পের সাথে যুক্ত রয়েছে বহুমুখী সেক্টর। যেমন: গন্তব্যস্থান,পরিবহন,আবাসন,খাবার দাবার,বিনোদন আর সাংস্কৃতিক নানা বিষয়। এই শিল্প কেবল বিদেশি মুুদ্রা অর্জনেই ভূমিকা রাখছে, তা নয়, এই শিল্পের বিকাশের ফলে স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য এবং কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও জোরালো ভূমিকা রাখে। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং ভাবনা আদান প্রদানে এই শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক বিশ্বে পর্যটন বা ট্যুরিজম একটি উন্নত শিল্পে উপনীত। কারণ অন্যান্য সেক্টরের মতো এই সেক্টরটিকে ডেভেলপ করে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। এই আয়ের পথটাকে সুগম এবং পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে তাই স্ব স্ব রাষ্ট্রই এসব দেশকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে তুলে। স্ব স্ব দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে অত্যন্ত সুন্দর ও নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে তারা এই সেক্টরকে রীতিমতো এক সার্থক শিল্পে পরিণত করেছে। এতে করে এসব দেশ বিশ্বের মানচিত্রে ট্যুরিজম এর জন্য জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান হয়ে উঠেছে,একই সাথে দেশের অর্থনীতিতেও এই সেক্টর বিশেষ অবদান রাখছে। আমাদের দেশ বিশ্বে সুজলা সুফলা শস্যশ্যমলা দেশ হিসেবে স্বীকৃত। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ভরা নাতিশীতোষ্ণ এই দেশ এর মাটি এমনই উর্বর যে, একটি বিচি পুতে দিলেই চারা উঠে যায় লকলকিয়ে। সেই চারা থেকেই গাছ, বৃক্ষ,তৃণ, লতাগুল্ম সবই জন্মায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই। আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে একদা ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা। নারীই ছিল পরিবারের প্রধান কর্তা। ক্রমে সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে পুরুষরাই পরিবার ও সমাজের প্রধান কর্তা হয়ে উঠে। তবে এক সময়ের সেই অবস্থারও পরিবর্তন হয়। নারী সমাজের কঠোর বেড়াজাল ভেদ করে শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে এসে সমাজ ও পরিবারে অবদান রাখে। তবে আমাদের
কৃষিখাতে নারীর অংশগ্রহণ আমরা সভ্যতার শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছি। নারী বীজ বোনা, চারা রোপণ, শস্য মাড়াই থেকে শুরু করে সেচ এর কাজসহ কৃষি সংক্রান্ত নানা কাজ করেছে। এখনো গ্রামাঞ্চলে কৃষি কাজে নারীদের সম্পৃক্ততা আমরা দেখি। যদিও এই কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আমরা এখনো পর্যন্ত দেখতে পাইনি। একইভাবে আমাদের পর্যটন সেক্টরেও বিভিন্নভাবে (সেটি হোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) নারীর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করি। যদিও এই বিষয়টি একেবারেই সুপ্ত, কোথাও কখনো কোনো আলোচনায় অনুপ্রেরণা, প্রশংসা কিংবা উৎসাহের যোগানদাতা হয়ে উঠে আসেনি। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। আর চট্টগ্রামের কথা তো একেবারেই আলাদা। পাহাড় সমুদ্র আর কর্ণফুলী নদীর কুলুকুলু ধ্বনিতেই চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্য এক অভিধায় চিহ্নিত বিশ্বের দরবারে। ১৮০০ সালে কোনো এক পরিব্রাজক চট্টগ্রাম ভ্রমণে এসে কর্ণফুলীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রামকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, এ যেনো এক ঘুমন্ত রাজকুমারী। কাজেই এই অনিন্দ্য সুন্দর নগরীর কেবল পর্যটন সেক্টরটাকে গুরুত্ব দিয়েই যদি নগরীকে ঢেলে সাজানো যায়, অবশ্যই এটি হবে ফলপ্রসূ এবং নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ।
এবার আসি পর্যটন শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা প্রসঙ্গে। ভ্রমণ পিপাসুদেরকে আমাদের দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলোর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে স্ব স্ব এলাকার ইতিহাস,ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,কৃষ্টির উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এই উপস্থাপনে প্রথমেই আসে বিভিন্ন স্থাপনা,কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, চারুকারু শিল্প ছাড়াও আমাদের পিঠা পুলি, খাবারদাবার, পোশাকআশাক ইত্যাদি। খাবারদাবারে আমাদের কৃষির বিষয় এসে যায় অনিবার্যভাবে। এখানে নারীই যেন নেপথ্য কারিগর, অথচ বিষয়টি অনুচ্চারিত। কুটির শিল্পেও নারীর অবদান অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে চারুকারু শিল্পে। এই শিল্পের হাত ধরেই নারীরা আজ ফ্যাশন ডিজাইনার, নারী উদ্যোক্তা। আমাদের নারীরা ইতিমধ্যেই তাদের তৈরি পোশাক নিয়ে হাজির হয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। চট্টগ্রামের ফ্যাশন ডিজাইনার আইভী হাসান বহু আগেই গ্রামীণ চেক দিয়ে স্পেনের রানি সোফিয়ার পোশাক তৈরি করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর তৈরি পোশাককে ইউরোপ,আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে এক দিকে যেমন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন, অন্যদিকে বৈদেশিক আয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন। শুধু কি ফ্যাশন ডিজাইন, রাঁধুনীরা নানা পদের রান্না ব্রাান্ডিং করে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করছেন। রাঁধুনীরা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য শুটকিকে নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট এর মাধ্যমে রসনাকে নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। চট্টগ্রামের ‘মেজবানি মাংস’ও এখন সমাদৃত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এই মেজবানী মাংস রান্নার মশলা পিষে দেয় কিন্তু নারীরা। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার শেফ প্রতিযোগিতায় আমাদের দেশের মেয়ে কিশোয়ার চৌধুরী তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর এই সাফল্য ও অর্জন আমাদের জন্য গৌরবের। আমাদের চট্টগ্রামের সেরা রাঁধুনী রওশন আরা মেজবানী মাংস রান্নায় সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি মেজবানী রান্নার স্পেশাল মশলাও নিজে তৈরি করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নারীরা নানা পদের আচার বানাচ্ছেন, আরেক সেরা রাঁধুনী জোবায়দা আশরাফ অন্যান্য রান্নার পাশাপাশি আচারকে প্রাধান্য দিয়েছেন
তিনি ১০০ পদ আচারের রেসিপি দিয়ে বিশাল এক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে নারীরা আজ ফলদ বাগান করেও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। মেরেডিয়ান এগ্রোর কোহিনুর কামাল আম্রপালিসহ বিভিন্ন জাতের আমের ফলন ও তা দেশে বিদেশে সরবরাহ এবং বিভিন্ন রিসোর্ট আর ট্যুরিস্ট স্পটে ভ্রমণ পিপাসুদের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। শুটকির নানা পদ করে মেলা করছেন। আবার রয়েছে বিউটিফিকেশন সেক্টর। এখানে রূপচর্চার বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি হেলথ ক্লাব, স্পা সেবাতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ্য করি। এসবের মাধ্যমে আমাদের নারীরা পর্যটন শিল্প বিকাশে অবদান রাখেন। আমাদের দেশে একসময় ভ্রমণ কিংবা বেড়ানোর অভ্যাস বা প্র্যকটিস ছিল না । কবির কথার মতোই ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দুর মতোই। যুগের পরিবর্তনে,কালের চাহিদায় মানুষ এখন কিছুটা বহির্মুখী হয়েছে। ফলে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল আর সৈকত নগরী কক্সবাজারে অগণিত হোটেল মোটেল, রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। আর এসব রিসোর্ট এর বিপণন কেন্দ্রগুলোতে নারীরাই দেশীয় পণ্য সামগ্রী বিকিকিনি করে থাকেন। এখানে আমাদের ট্রাডিশনাল পণ্য এবং হ্যান্ডিক্র্যাফট ট্যুরিস্টদের নজর কাড়ে। আর পাহাড়ে তো নারীদেরই অবাধ ও বীরদর্প বিচরণ নারীদের। যদিও নারীর যাবতীয় অবদান নেপথ্যে থাকে বরাবরই, দৃশ্যমান থাকে না। কারণ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কেউ ভাবেন না। এসব বিষয় আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবেও খুব একটা স্থান পায় না। ফলে নারীর এই গুরুত্বপূর্ণ অবদান থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালেই। নারীর অসামান্য এই কর্মক্ষমতাকে হাইলাইট করা এখন সময়ের দাবি। একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ আমরা অতিক্রম করছি। আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পও অনেক বিকশিত হয়েছে। প্রতিদিনই নিত্যনতুন স্পটকে ঘিরে চমৎকার ও নান্দনিক শৈলী সমৃদ্ধ ভ্রমণ স্পট গড়ে উঠছে। তাই এই শিল্পকে গতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে নারীদের অবদানকে স্বীকার করে আরো বেশী বেশী কীভাবে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তা চিন্তা করতে হবে। নগরীতে এখন পাঁচতারকা হোটেল গড়ে উঠেছে। এই ব্যাপারে রেডিসন ব্লু, অন্যান্য হোটেল, হোটেল আগ্রাবাদসহ উইমেন চেম্বার এবং পর্যটন ব্যুরো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। মূলত পর্যটন শিল্পে আমাদের নারীরা বর্তমানে অনেক সম্পৃক্ত। বিমান চালনায় নারী, ট্র্যাভেল এজেন্সিতেও নারী, রিসোর্ট, হোটেল মোটেল পরিচালনায়ও নারী। তবে তাদেরকে ট্রেনিং, প্রশিক্ষণ দিয়ে, বেশী সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে বিষয়গুলোকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের এলাকাভিত্তিক বিখ্যাত যে কোনো জিনিসকে ফোকাস আর ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন মহেশখালীর পান, হাটহাজারীর লাল মরিচ,পাহাড়ি আদা আর হলুদ, পার্বত্য অঞ্চলের আম, বাঁশখালির লিচু,আদিবাসীদের কোমর তাঁতে বোনা কাপড়, পাহাড়ের গোলমরিচ, ফকির কবিরের সেমাই, গনি বেকারির বেলা এবং মশলাসহ এই ধরণের বহু আইটেম এর সাথে নারীদের একীভূত করে, প্রশিক্ষণ প্রদান করে পর্যটন সেক্টরের সাথে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। এতে করে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে,আর নারীরা হবে স্বাবলম্বী, এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। নারীর অগ্রযাত্রা প্রসারিত ও বিকশিত হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
আমি একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। পেশায় সাংবাদিক হওয়ায় দেশের আনাচে–কানাচে এমনকি বিদেশে আমার যাবার সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রামের এমন এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরেছি আমি, যেখানে সর্বসাধারণের যাবার সুযোগ হয় না। আমি আবার ভ্রমণ লেখকও। ঘরের সংগীটি আলোকচিত্রী আর শিল্পী হওয়ার সুবাদে আমার ভ্রমণগুলো সবসময় থাকতো আনন্দমুখর। এমনই আছে, আমি কিছু কিছু স্পট একাধিকবার ভ্রমণ করেছি। প্রতিটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত কিন্তু লিখেই পত্রিকায় ছেপেছি। পাঠকদের সাথে শেয়ার করেছি। সবকিছু বাদ দিয়ে যদি আমরা নগরীর সিআরবির সাত রাস্তার মোড় আর পলোগ্রাউন্ডের পাহাড়ঘেঁষা উপর আর নীচের রাস্তাটা দেখি তখন কেমম লাগে? ন্যাচারাল রাস্তাগুলি যদি উন্নত কোনো দেশ পেতো, কি সুন্দর করেই না ম্যান্টেইন করতো! অথচ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে পেয়েও আমরা কি এদের সুন্দরভারে সাজিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি? আসুন পর্যটন শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমরা আমাদের নগরীর যে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর ও নির্মোহ পরিবেশ তা সংরক্ষণ করে, তাকে পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই।