অর্থনীতির মুকুট হচ্ছে পর্যটন। পর্যটনশিল্প ১০৯টি শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করে। পর্যটনশিল্প প্রতি আড়াই সেকেন্ডে একটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে ১১ জন মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পান আরও ৩৩ জন। অর্থাৎ এক লাখ পর্যটকের আগমনে ১১ লাখ কর্মসংস্থান যুক্ত হয়।
পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিকমানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ৯ জুন জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে দেশের পর্যটন শিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে। ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ স্লোগান নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। এই বাজেটে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৭ হাজার ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৩২ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বিভাগ পর্যটনের বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় বাঙালি জাতি সত্তার সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আচার অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অপূর্ব মেলবন্ধন রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও।
বর্তমানে অস্ত্র ও তেল শিল্পের পর তৃতীয় অর্থ আনয়নকারী শিল্প হলো পর্যটন শিল্প। পৃথিবীর বহু দেশের প্রধান আয়ই এই পর্যটন থেকে। যেমন মালদ্বীপ, মাদাগাস্কার, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং সমস্ত ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। পর্যটনের প্রধান অনুষঙ্গ পাহাড়, সাগর সমৃদ্ধ সবুজ প্রকৃতি। এই তিনটিই চট্টগ্রামে অবস্থিত। ফলে চট্টগ্রাম অনেক আগেই বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। অথচ পরিকল্পনা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার জন্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্প বিশ্বমানের অনেক নিম্নে।
ইতোপূর্বে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকলেও কেবলমাত্র যথাযথ উদ্যোগের অভাবেই পুরো খাতটি মারাত্মকভাবে মার খাচ্ছে। পাহাড়, নদী ও সাগরের অপূর্ব মিলনস্থল চট্টগ্রামে পর্যটনের নানা উপকরণ প্রাকৃতিকভাবে থাকলেও যথাযথ উপস্থাপন করতে না পারায় সব আয়োজনই ব্যর্থ হচ্ছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বেসরকারিভাবে অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও রেস্ট হাউজ গড়ে উঠেছে। বেসরকারি উদ্যোগে পাঁচ তারকা হোটেলও হয়েছে। কিন্তু পর্যটনের বিকাশ যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুন্নত অবকাঠামো, পর্যটন স্পটগুলোকে বিশ্বমানে রূপান্তর না করা, স্পট সংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাড়তি আকর্ষণ তৈরি না করা, সাংস্কৃতিক আয়োজন না থাকা, পরিচালনে রাজনৈতিক প্রভাব, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব ও সর্বোপরি সরকারের সুনজর না থাকায় এই অঞ্চলের পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ঘটছে না। তবে এসব ক্ষেত্রে নজর দিতে পারলে দেশের পর্যটন খাতের আয়কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্পটগুলো।
বাংলাদেশের সংবিধানে বিনোদন ও বিশ্রামের অধিকার রয়েছে। সে হিসেবে সরকার সংবিধানের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে সচেষ্ট থাকবে। তাই দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে। দেশকে আবিষ্কারের জোঁক বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশের দিকে নজর দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম শহরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কর্ণফুলী নদী, আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকতসহ শহরে অনেক দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু এখানকার কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের আকর্ষণে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। এছাড়াও উপজেলাগুলোতে কয়েকটি ইকোপার্ক, এভিয়ারি পার্ক, ঝর্ণা, লেকসহ স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। যেগুলোর কোনো কোনোটি পর্যটকদের কাছে জাতীয়ভাবেও পরিচিতি লাভ করলেও প্রশংসা করার মতো কিছু দেখাতে পারে নি। পর্যটনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরাপত্তা, সমপ্রীতি ও পর্যটন শিল্পের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। এর শত্রু হচ্ছে জঙ্গি ও সামপ্রদায়িকতা। বর্তমান সরকার সামপ্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ ‘জিরোনীতিতে’ রয়েছে। জাতভেদ, ধর্ম বর্ণ সামপ্রদায়িকমুক্ত রাজনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পর্যটনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পর্যটনশিল্পে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। দেশীয় উদ্যোক্তারা এখাতে বিনিয়োগ করলে বিদেশিরাও এগিয়ে আসবে। এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সকলেই একমত যে পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিনিয়োগ করলে তাতে নতুন গতি আসবে।