বলা হয়ে থাকে– ‘সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম একটি জনপদের গণমানুষের মনের জগতে পরিবর্তন এনে পুরাতন সভ্যতা ভেঙে সেখানে নতুন সভ্যতা তুলতে পারে।’ হাঁ, চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী মানুষের মননে–চেতনায় পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। যা চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্প ও সাহিত্য–সাংস্কৃতিক জগতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আজকের দৈনিক আজাদী– চৌষট্টি বছরের পরিণত একটি দৈনিক। এই পত্রিকা পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছে। সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে দৈনিক আজাদী চলমান রয়েছে। এই পত্রিকা চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে আপোষ করেনি। শুরু থেকেই চট্টগ্রামের মানুষের অধিকারের কথা বলেছে আজাদী। দৈনিক আজাদীর বিশেষত্ব লক্ষ্য করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে, সত্য প্রকাশের ব্যাপারে অদৃশ্য রক্ত চক্ষুকে তোয়াক্কা না করাই আজাদীর বিশেষত্ব।
দৈনিক আজাদী পত্রিকা আমার জন্মের আগের পত্রিকা। এই পত্রিকা আমাদের পাড়া– প্রতিবেশী–বাবা–চাচারা পড়েছে, আমরাও আজাদী পড়ছি, আমাদের সন্তানেরা আজাদী পড়বে, হয়তো নাতি–পতিরাও আজাদী পড়বে। কয়েক প্রজন্ম ধরে একটি পত্রিকা পড়ার নজির শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীতেও খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। একটি পত্রিকা ৫ যুগেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকা এবং শত বছরের অধিক সময় টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ নিতে পারা–এর পেছনে নিশ্চয়ই রহস্য লুকিয়ে আছে। কী সেই রহস্য! দৈনিক আজাদীর শ্রদ্ধেয় সম্পাদকের মুখেই শোনা যাক সেই রহস্যের কথা। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘এই পত্রিকা এতদূর পর্যন্ত নিয়ে আসতে আমি দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেছি, যা হয়তো আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না।’ তিনি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম–কে স্মরণ করে বলেন, ‘আজাদীকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে আমি ঘুমাতে পারতাম না।’ হাঁ, তাঁর পরিশ্রমের ফসল আজকের দৈনিক আজাদী। তিনি আরও বলেন, ‘আজাদীর প্রচার সংখ্যা অনেক জাতীয় পত্রিকা হতেও বেশি। আর দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের জন্য আমার বাবা সৃষ্টি করেছিলেন। চট্টগ্রামের মানুষের সুখে–দুঃখে পাশে থাকাই দৈনিক আজাদীর অন্যতম উদ্দেশ্য। চট্টগ্রামের মানুষের কথা বলতে গিয়ে অনেক রক্ত চক্ষুকে আমরা উপেক্ষা করেছি। দৈনিক আজাদী সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আজীবন কাজ করবে। এবং দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের মানুষের পত্রিকা হয়েই থাকবে।’
সম্পাদক মহোদয়ের কথার মধ্যে আজাদীর সাফল্যের রহস্য উঠে এসেছে। মূলত, মেধা, অধ্যবসায় ও ন্যায়নিষ্ঠতাই একটি প্রতিষ্ঠানকে সাফল্য এনে দিতে পারে। আর, একটি পত্রিকার সাফল্যের পেছনে এসবের পাশাপাশি ‘পাঠকের মনোভাব’ বুঝতে পারাও অন্যতম শর্ত। দৈনিক আজাদী সেই শর্ত পূরণ করতে পেরেছিলো বলেই এতদূর এগিয়ে আসতে পেরেছে।
প্রসংগক্রমে সংবাদপত্রের কর্তব্য সম্পর্কে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২০১২ সনের ২৮ অক্টোবর তারিখে লিখিত সম্পাদকীয়’র সামান্য অংশ তুলে ধরে যায়। আনন্দবাজার লিখেছিলো, ‘আদর্শ সংবাদপত্রের কর্তব্য কী? বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করিয়া সে বিষয়ে ঔচিত্য–অনুচিত্রের দৃষ্টিকোণ আনিয়া পাঠককে শিক্ষিত করা ও সমাজের অনিয়মগুলির প্রতি কর্তৃপক্ষ ও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। হয়তো পূর্বে সংবাদপত্র ভাবিতো– সাধারণ মানুষের রুচি গড়িবার পবিত্র দায় তাহার রহিয়াছে। এখন সে মনে করে, মানুষের রুচি অনুযায়ী নিজেকে না গড়িলে লক্ষ্মী পলাইবেন।’ আনন্দবাজার পত্রিকার এই সম্পাদকীয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সংবাদপত্রের প্রকৃত দায়িত্ব কিন্তু মানুষের মধ্যে সুরুচির উদ্যোগ তৈরি করা। কিন্তু বর্তমানে অনেক সংবাদপত্র সুরুচি তৈরি না করে বরং উলটো মানুষের রুচি অনুযায়ী নিজেকে সাজাচ্ছে। সুখের কথা যে, আমাদের আজাদী সেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে স্বকীয়তা ধরে রেখেছে, যা আমাদের জন্য স্বস্তিদায়কও বটে।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আজাদী কারও লেজুড়বৃত্তি না করে জনগণের স্বার্থ দেখেছে। সুশাসন ও গণতন্ত্রের কথা বলেছে। মোসাহেবি, অন্যায় ও অসত্যকে বর্জন করেছে। মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের বিষয়টি প্রমাণ হলে আজাদী কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও দ্বিধা করেন না। আজাদী যখন বিজ্ঞাপনের চিন্তা না করে ‘জাতিসংঘ পার্ক উন্মুক্ত করার’ কথা বলে, তখন চট্টগ্রামের মানুষ আজাদীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়। আজাদী যখন সন্ত্রাস ও জংগীবাদ বিরোধি অবস্থান নেয়, তখন সারাদেশ ও সমাজ উপকৃত হয়। একথা স্বীকার্য যে, নবীন লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আজাদী অসাধারণ একটি কাজ করেছে। আজাদীর বদৌলতে চট্টগ্রাম পেয়েছে অনেক কবি, গল্পকার, লেখক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট। আজাদীর রকমারি সব বিভাগ পাঠকদের আকৃষ্ট করে তাঁদের মনের অজান্তে। বাংলাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশ ও চলমান রাখা খুব একটা সহজ নয়। কারণ সংবাদপত্র যখন বিভিন্ন নিয়ম তুলে ধরে, তখন অনিয়মকারীরা সংবাদপত্রকে প্রতিপক্ষ মনে করেন। ফলে সৃষ্টি হয় জটিলতা। তাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে সংবাদপত্রকে এগিয়ে নিতে হয়। যা বুঝা যাবে আরএসএফ‘র পরিসংখ্যান দেখলে। ২০ এপ্রিল‘২৩ তারিখে আন্তর্জাতিক রিপোর্টার্স সংগঠন ‘রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স’ (আরএসএফ) ২০২১ সনের ‘মুক্ত গণমাধ্যম সূচক’ প্রকাশ করেছে। যাতে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের এখানে মুক্ত– সংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই দৈনিক আজাদীর মত পত্রিকা গুলো চলমান রয়েছে, যা বলাবাহুল্য মাত্র।
আজাদীর সম্পাদক ও পরিচালনা সম্পাদকের সাথে আমরা যখন কথা বলি, তখন তাঁদের ‘বিনয়ী আচরণ’ আমাদের শিক্ষার উপকরণ হয়। আমাদের দেশের উপরতলার মানুষদের মাঝে সচরাচর বিনয়ী আচরণ কমই দেখা যায়। কিন্তু এই মানুষদ্বয়ের ব্যতিক্রমি ও পজিটিভ আচরণ আমাদের শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দেয়। আজাদীর সম্পাদক মহোদয়ের বিনয়ী আচরণ হযরত সোলাইমান (আ.) এর একটি আপ্তবাক্যকে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘অহংকার মানুষের পতন ঘটায়, আর বিনয় মানুষের মাথায় সম্মানের মুকুট পরায়’। যা হয়তো তিনি ব্রত হিসাবে নিয়েছেন।
ফরাসি দর্শনিক ‘ভলতেয়ারের‘ বিখ্যাত উক্তি হলো, ‘আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি। কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেব।’ হাঁ, দৈনিক আজাদী মানুষের কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে আগেও যেমন ছিলো, আগামীতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে– এমন প্রত্যাশা রইল। দৈনিক আজাদী শতবর্ষ উদযাপন করুক–এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।