সম্প্রতি দেশের নগর–শহর–প্রান্তিক জনপদে বহুমাত্রিক অপরাধ বেপরোয়া রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্যসূত্রে জানা যায়, দেশে চুরি– ডাকাতি– ছিনতাই– রাহাজানি– হত্যাসহ জমি– দোকান– সম্পদ দখলের মহোৎসব চলছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অভূতপূর্ব সার্থকতার ফলশ্রুতিতে উচুমার্গের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে অভিষিক্ত হয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর স্বকীয় ভাবমুর্তিতে সমগ্রবিশ্বে বাংলাদেশ হয়েছে অধিকমাত্রায় আলোকোজ্জ্বল। বিশ্বপরিমন্ডলে অপরিসীম মর্যাদায় সমাসীন পুরো জাতি এখন গৌরবদীপ্ত। ইতিমধ্যেই চলমান সরকারের সাফল্যগাঁথায় যুক্ত হয়েছে শ্রমবাজার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধি। উন্নত–অনুন্নত দেশসহ দাতা–সহযোগী বিশ্বসংস্থার সকলের অসাধারণ সহযোগিতা প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান। রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি কমিশন। সৎ– দক্ষ– যোগ্য– অভিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে গঠিত কমিশনসমূহ স্ব স্ব প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। দেশের আপামর জনগণের হৃদয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবতর আশা সঞ্চারিত হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষরূপী হিংস্র দানবদের সিন্ডিকেট কারসাজিতে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সুদূরপরাহত। দরিদ্র–নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় নানামুখী সংকট পরিলক্ষিত। সামান্য তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অহরহ সড়ক অবরোধ দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু অঞ্চলে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন–সংগ্রাম যানজট ও জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি অনেকটুকু স্বাভাবিক হয়ে আসলেও পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থার কার্যকারিতা পর্যাপ্ত বলা যাচ্ছে না। এমন সব দুর্বলতার সুযোগে দেশবিরোধী চক্রান্ত–ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্নভাবে সরকারকে বিব্রত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহর– জেলা– উপজেলার কিছু কিছু এলাকা রীতিমতো অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ডাকাতি–গণছিনতাই– লুট– খুন– মাদক ব্যবসাসহ এমন কোন অপরাধ নেই যা ঐসব জায়গায় সংঘটিত হচ্ছে না।
একই সাথে পাল্লা দিয়ে দেশব্যাপী বৃদ্ধি পেয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া বিস্তার। ঢাকা–চট্টগ্রামসহ প্রতিটি জেলা শহরগুলোতে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং চক্র গড়ে উঠে। যারা খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়েছে। নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষ–মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। বিগত সরকারের শাসনামলে চলতি বছরের মে মাসে কিশোর গ্যাংদের তৎপরতা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিলকৃত বিশেষ প্রতিবেদন মতে, দেশব্যাপী কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ২৩৭টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ছিল ৩১৬ জন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে গড়ে ওঠেছে অপরাধের নতুন সাম্রাজ্য। ৫ আগস্টের পর থেকে অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত শুধু ঢাকার মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছে ১০ জন। এসব খুনের নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ ও বাজার দখল ইত্যাদি। তাছাড়া এই এলাকায় প্রকাশ্যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মহড়া ও গোলাগুলি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বা ডিবি পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোহাম্মদপুর এলাকার তিন রাস্তার মোড়, চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর, তুরাগ হাউজিং, আক্কাস নগর, ঢাকা উদ্যান নদীর পাড়, চন্দ্রিমা হাউজিং, বসিলা হাক্কার পাড়, আদাবর, শ্যামলী হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, তাজমহল রোড, নুরজাহান রোড, শ্যামলী রিং রোড, রায়েরবাজার, হুমায়ন রোড ও বাবর রোডের আশেপাশে জেনেভা ক্যাম্প এলাকা, টাউন হল ও আসাদ অ্যাভিনিউয়ের আশপাশ, আজম রোড, ইকবাল রোডে কিশোর গ্যাং জাতীয় অপরাধীদের তৎপরতা বেশি। ছোটবড় মিলিয়ে এই এলাকায় আছে ৩০টি কিশোর গ্যাং। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঠেলার নাম বাবাজি, ডায়মন্ড গ্রুপ, সালাম পার্টি, আসসালামু আলাইকুম পার্টি, দে ধাক্কা গ্রুপ, ব্রেকফাস্ট পার্টি, টক্কর ল, পাটালি গ্রুপ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল–চিনে ল, ল ঠেলা গ্রুপ, কোপাইয়া দে, ভাইপার, তুফান, টিকটক, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার, এসকে হৃদয় গ্রুপ, রনি গ্রুপ ও বিচ্ছু বাহিনী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভাষ্য, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র চলে যায় অপরাধীদের হাতে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ভয়াবহ অপরাধ করছে স্থানীয় কিশোর গ্যাংসহ সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। ২৬ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ৭২ ঘন্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আলটিমেটাম দিয়ে থানা ঘেরাও করে স্থানীয়রা। এরই প্রেক্ষিতে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে এক সপ্তাহে ১৮০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র। উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন স্থান থেকে লুট হওয়া টাকা, স্বর্ণালংকার ও মালামাল।
সম্মানিত পুলিশ মহাপরিদর্শক সন্ত্রাস–ছিনতাই–চাঁদাবাজি–মাদক–কিশোর গ্যাংসহ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান জোরদার করতে পুলিশের সকল ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর ২০২৪ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশব্যাপী চলতি ১৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র–জনতার ওপর হামলাকারী, গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলার আসামিসহ অন্যান্য মামলার আসামিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী তল্লাশিচৌকি বা চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশি টহল জোরদারের সাথে বাড়ানো হয়েছে টহল দল ও গোয়েন্দা নজরদারি। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও অস্থায়ী চেকপোস্ট, ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম কার্যকর রয়েছে। এছাড়া দেশব্যাপী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণও অব্যাহত।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সূত্রে জানা যায়, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাশাপাশি সংস্থাটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড রোধ ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে দেশব্যাপী নিরপেক্ষতা–পেশাদারিত্বের সঙ্গে যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচলানায় নিয়োজিত। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধ প্রবণ এলাকায় তাদের যৌথ অভিযান সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে। অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক কারবারী, কিশোর গ্যাং হোতা গ্রেপ্তারসহ উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, মাদকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র। ৪ সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া যৌথ অভিযান সাম্প্রতিক সময়ে আরো জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে অভিযানের পরিধি ও সংখ্যা। যৌথ অভিযানে কিছু কিছু এলাকায় ব্লক রেইড ও কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালনা করা হচ্ছে। অংশগ্রহণও বেড়েছে সশস্ত্র বাহিনী–পুলিশ–বিজিবি–র্যাব–আনসার–কোস্টগার্ডসহ সকল বাহিনীর।
৫ নভেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যৌথ অভিযানে ৩৬৭টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১৬৭টি। অভিযানে গ্রেপ্তারকারীর সংখ্যা ২১৭ জন। ৩১ অক্টোবরের পর ৪ দিনে আরও শতাধিক অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে– রিভলবার, পিস্তল, রাইফেল, শর্টগান, পাইপগান, শুটারগান, এলজি, বন্দুক, একে৪৭ রাইফেল, এসএমজি, গ্যাসগান, এয়ারগান, এসবিবিএল, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ও থ্রি–কোয়াটার ইত্যাদি। এছাড়া পুলিশের লুট হওয়া ৬ হাজার ৭৪৯টি অস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদের মধ্যে গত ২ নভেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে যথাক্রমে ৪ হাজার ৩১৩টি অস্ত্র ও ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৮২টি গোলাবারুদ। সম্মানিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টায় যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ৬ নভেম্বর ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে আরও উন্নতি কীভাবে করা যায় সে চেষ্টা চলছে। মোহাম্মদপুর মডেলে পুরো শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা হবে। কোনো চাঁদাবাজ বা কোনো অপরাধীর ছাড় নেই, সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন।’
সার্বিক পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত হলেও অধিকাংশ অপরাধীরা এখনও প্রকাশ্যে তাদের অপতৎপরতা চালু রেখেছে। চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য নগর–শহরেও ফ্লাইওভার ও বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের যানবাহন ছিনতাই অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। জনশ্রুতিমতে, গ্রামগঞ্জেও চুরি–ডাকাতির ভয়ে জনগণ গভীর আতঙ্কিত। যৎসামান্য ধনসম্পদ রক্ষার্থে তারা যারপরনাই কাতরতায় ভুগছে। এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা না গেলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব দুর্বৃত্তায়ন রোধ করা দুরূহ ব্যাপার বটে। মসজিদ–মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়মিত নীতি নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের বক্তব্য প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ–যুবকদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ দমনের নানা উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী