পরিযায়ী পাখির বিচরণ ক্ষেত্র

বদরুননেসা সাজু | শনিবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

শীতের পাখির পরিযান বা মাইগ্রেশন (অভিপ্রয়াণ) বেশি দূরত্বের ব্যবধানে এবং নিয়মিতভাবে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে। প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রভাব এড়ানো, নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা, খাদ্যের সহজ লভ্যতা এবং প্রজনন সুবিধাপ্রাপ্তির খোঁজে পাখিরা হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে। অর্থাৎ বছরের-পর-বছর তারা একই সময়ে একই পথে আগমন করে এবং ঠিক একই সময় একই পথে আবার ফিরে যায়। এভাবে পৃথিবীর এক ভৌগোলিক অঞ্চল ছেড়ে অন্য ভৌগোলিক অঞ্চলে গমনের পর অনুকূল পরিবেশে কিছুসময় অতিবাহিত করে এবং পুনরায় পূর্বের আবাসস্থলে ফিরে যায়। পাখিদের এরূপ অনুকূল পরিবেশের দিকে দেশান্তরী হওয়া এবং ফিরে আসার নাম পরিযান বা মাইগ্রেশন ( অভিপ্রয়াণ)। এসকল পাখিকে পরিযায়ী পাখি বলা হয়। এরূপ পাখিরা প্রতিবছরের নির্দিষ্ট সময়ে অতিরিক্ত ঠান্ডা এবং বরফ পড়ায় শীতকালীন আবাস থেকে গ্রীষ্মকালীন নিবাসের দিকে যাত্রা করে পরিযায়ী হয়।
অন্য কোন প্রাণীতে এরূপ দেখা যায় না বলে এটি মানুষের চোখে বিস্ময়কর ও মনোমুগ্ধকর হিসেবে দৃশ্যমান হয়। অনেক প্রাণী মাইগ্রেশনে অভ্যস্ত হলেও পাখিরাই কেবলমাত্র নিয়ম তান্ত্রিকভাবে মাইগ্রেশন সম্পন্ন করে। মূল নিবাস থেকে গন্তব্যস্থলে এবং গন্তব্য স্থল থেকে মূলনিবাসে ফেরার সময় পাখিরা সাধারণত খুব দূর থেকে দেখতে পায় এবং তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে কোন স্থানকে চিনতে পারে(যেমন পর্বত, নদী, সমুদ্র তটরেখা)। তারকারাজি, চন্দ্র ও সূর্যের ঘূর্ণন সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাকে ও পরিযায়ী পাখিরা রাতে ও দিনে পথ চেনার জন্য কাজে লাগায়।
তবে উড্ডয়নের সময় প্রধানত চোখের দৃষ্টি এবং ভূপৃষ্ঠের চৌম্বক ক্ষেত্রকেও পাখিরা কাজে লাগায় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। পাখিরা দলবদ্ধভাবে যাতায়াত করে। প্রথমে বয়স্ক পাখিরা পরিযায়ী হতে শুরু করে, পরে স্ত্রী ও তরুণরা তাদের অনুসরণ করে। ফিরতি অভিযানে তরুণ পাখিরা নেতৃত্ব দেয়। পাখিরা সব সময় একই পথ ধরে পরিযায়ী হয় এবং ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে পৌঁছে। এক দিনে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা উড়বার পর খাদ্য ও পানীয়ের জন্য পাখিরা বিশ্রাম নেয়। কিন্তু গোল্ডেন প্লোভার পাখি বিরতিহীন উড়ে চৌদ্দশ মাইল দূরবর্তী দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে। কিছু স্থলচর পাখি সমুদ্রপথে ৪০০ মাইল পর্যন্ত অতিক্রম করে যায়। কিন্তু মধ্যবর্তী কোন স্থানে দ্বীপ থাকলে পাখিরা আরো বেশি পথ অতিক্রম করতে পারে। পাখির বিভিন্ন গমন পথের মধ্যে রয়েছে সমুদ্র উপকূলীয় নদী, নদী বিধৌত ভূখণ্ড ও পার্বত্য পথ। সমুদ্রপথ সাধারণত সামুদ্রিক পাখিরা ব্যবহার করে। পর্বতগুলো পরিযায়ী পাখিদের দিক নির্দেশক চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর অতিবিপন্ন একটি পাখি, নাম -চামচঠোঁটি কাদাখোচা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তার জন্য রাশিয়া থেকে পরিযায়ী হয়। নির্দিষ্ট সময়ে পুনরায় স্থায়ী বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এর বাংলাদেশ সফরের সমাপ্তি ঘটে।
বাংলাদেশে শীতকালে আগত অধিকাংশ পরিযায়ী পাখিরা হিমালয়ের উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চল মঙ্গোলিয়া, নেপাল, উত্তর ইউরোপ ও সাইবেরিয়া হতে এসে এখানকার খাল বিল ঝিল হাওড়-বাওড় নদ-নদীতে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দেশে সিলেটের মৌলভী বাজারের হাকালুকি হাওড়,শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওড়ের বাইক্কার বিল, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার বিল, রাজশাহীর বাঘার বিভিন্ন দীঘি ও নওটিকা বিল, সুন্দরবন, বাগেরহাটের বিভিন্ন হাওড় ও বিল, নেত্রকোনার হাওড় সমূহ, চলনবিল, আড়িয়াল বিল,
বরিশালের দুর্গাসাগর হাওড়,ভোলার চর কুকরি-মুকরি অভয়াশ্রম, দিনাজপুরের রামসাগর বিল,গোপালগঞ্জ -খুলনা বিল,পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই লেক, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, চট্টগ্রাম রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল প্রভৃতি স্থানে হাজার হাজার পরিযায়ী (অতিথি) পাখি এসে এসে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, সিরামিক লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বঙ্গ ভবন চত্বর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশেপাশের জলাশয়গুলোতে অতিথি পাখিদের ঝাঁক বেঁধে বিচরণের দৃশ্য ও কলকাকলিতে আমরা দারুণভাবে মুগ্ধ হই। এছাড়া আমাদের দেশের অন্যান্য বেশকিছু ছোট-বড় লেক ও জলাভূমি অঞ্চলে পরিযায়ী পাখিরা এসে বসবাস করে প্রজনন ঘটায় এবং শীতের শেষে ফিরে যায়। বাংলাদেশে যে সকল পরিযায়ী পাখি দেখা যায় তাদের মধ্যে আছে -ধূসর রাজহাঁস, ছোট লাল শির,
হুদহুদ, জল কবুতর, চখাচখি, চা পাখি, সাদা খঞ্জনা, বুনো রাজহাঁস, সাদা মানিকজোড়, জলপিপি, ছোট ও বড় সরালি, বালিহাঁস ইত্যাদি। এদের শিকার করা কিংবা ফাঁদ পেতে ধরা অন্যায়। পরিবেশের (বাস্তুতান্ত্রিক) ভারসাম্য রক্ষায় এদের গুরুত্ব অপরিসীম। সমস্ত হাওর এলাকা পরিযায়ী পাখির জন্য সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। আইনে বিশেষ বিধান করে এগুলো সুরক্ষার ও ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও কিছু নিষ্ঠুর লোভী মানুষ-ঘাতকের হাত থেকে এরা রেহাই পায় না। শিকারী ঘাতকেরা কখনো ফাঁদ পেতে আবার কখনোবা বিষটোপ দিয়ে এদের ধরে ফেলে। পাখি বিক্রি করা এবং খাওয়ার লোভ সংবরণ করা এদের পক্ষে কঠিন। এগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি শিকার বা নিধন বন্ধ করার জন্য ১১ মে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে পোস্টার প্রদর্শন করা যায়। এর দ্বারা জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী ফরিদ আহমদ স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে