প্রতিবছর বাজেট আসে, আর শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা শোনা যায় প্রতিবারই। খাতটিকে বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথাও বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। ২০২৩–২৪ অর্থ বছরের জন্য গতকাল প্রস্তাবিত বাজেটেও শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্লেষকেরা বলছেন– শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ তার জিডিপির যে অংশ ব্যয় করছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। বছর বছর কেবলই প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বৃত্তেই ঘোরপাক এ খাতের। কোনো বছরই যেন খাতটিতে প্রত্যাশিত হারে বরাদ্দ বাড়ছে না। গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোট বাজেটের আকার বড় হওয়ার কারণে শিক্ষায় বরাদ্দের পরিমাণটাও বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না বরাদ্দের আনুপাতিক হার। বরং মোট বাজেটের বরাদ্দের শতকরা হার প্রায় প্রতিবছরই কমেছে এ খাতে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি (২০২২–২৩) অর্থবছরে মোট ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে কেবল শিক্ষাখাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১২.০১ শতাংশ। আর এবারের প্রস্তাবিত ২০২৩–২৪ অর্থ বছরের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটে এ খাতে মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে যা মোট বাজেটের ১১.৫৭ শতাংশ। হিসেবে গতবারের তুলনায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে। তবে বরাদ্দের হার উল্টো কমেছে। গতবছরের তুলনায় বরাদ্দের হার কমেছে ০.৪৪ শতাংশ।
এদিকে, এবার শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দের হার দাঁড়িয়েছে মোট জিডিপির (বার্ষিক জাতীয় আয়ের) ২.০৭ শতাংশ। আর শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দের এ হার ২ শতাংশের কম। এই বরাদ্দকে জিডিপির অনুপাতে খুবই অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন বেসরকারি ইস্ট–ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান। এই শিক্ষাবিদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দকেই আদর্শ মান হিসেবে ধরা হয়। জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দিতে না পারলেও আমাদের প্রতিবেশি সব দেশ শিক্ষাখাতে ৪ শতাংশের ঊর্ধ্বে বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সে তুলনায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।
‘শিক্ষা খাতে প্রতিবারই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর কথা আমরা শুনি। কিন্তু এই বাড়ানোর পরিমাণটা গতানুগতিক বলেই আমরা মনে করি। এটি গতিপথ ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষায় গুণগত তেমন পরিবর্তন আশা করা যায় না। তবে এবার অর্থমন্ত্রীর কথায়ও শিক্ষা খাতকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।’ মু. সিকান্দার খান বলেন, আমরা যেসব দেশের সমকক্ষ হওয়ার আশা করি, সেসব দেশ ছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের তুলনায় দুর্বল অনেক দেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা তলানিতেই বলা যায়। তাছাড়া প্রকৌশল ও কারিগরি খাতেও আশানুরূপ বরাদ্দ হয়নি। ভবিষ্যতে আমরা যেখানে যেতে চাই, সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে অভিমত শিক্ষাবিদ সিকান্দার খানের।
উল্লেখ্য, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের জন্য উপস্থাপিত এই বাজেট প্রস্তাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। হিসাবে নতুন অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের অনুপাতে ১ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে।
এবার প্রস্তাবিত বরাদ্দের মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্য থাকছে ১৫ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এর মাঝে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১৩ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। হিসেবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের বরাদ্দ এবার কমেছে।
শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের মধ্য থেকে এবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগকে ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। আর চলতি (২০২৩–২৪) অর্থ বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।