পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা চাই

দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর খাত

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১১ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর সব দেশ ও অঞ্চলে রয়েছে প্রকৃতি প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এরমধ্যে আছে সাগর, নদী, লেক, পাহাড়, পর্বত, ঝর্ণা বনাঞ্চল ও খনিজ সম্পদ। যে দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে, সে দেশ উন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদের চরম অপচয় ও অবহেলা চোখে পড়ার মতো। কিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদকে দ্রুত নিঃশেষ করা যায়, চলে তার প্রতিযোগিতা। এখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় পাহাড় নদী নালা খাল বিল পুকুর দখল ও বিলীন করা হয়। হাজার হাজার টন বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে পরিবেশ দুষণ করা হয়। নদী নালা খাল বিলে ফেলা হয় তরল বিষাক্ত বর্জ্য। গাছ কেটে সাবাড় করা হয় নগর, গ্রাম, শহর ও বনাঞ্চল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই কাজগুলো করা হয় খোদ রাজধানী সহ সারাদেশে। প্রশাসনের চোখের সামনে এবং যারা এগুলো রক্ষার দায়িত্বে আছে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায়।

মোঘল, সুলতানি ও জমিদারি আমলে বা তারও আগে পরে দেশের শহর বন্দর নগরগুলোর পত্তন করা হয় নৌপথের সুবিধার কথা মাথায় রেখেনদী বা সাগরের মোহনায়। তখন দুইটি দিক মাথায় রেখে নগর পত্তন করা হতো। যাতায়াতের সুবিধা ও পানীয় জলের প্রাপ্তি। বড় বড় সওদাগরি নৌকার সাহায্যে পণ্য পরিবহন করা হতো ও নৌপথ ছিলো মানুষের চলাচলের প্রধান রুট। কিন্তু দখল, ভরাট, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ খননের অভাবে সে সব নদী ও নৌপথ আজ মৃত প্রায়।

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদী হলো পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্র কর্ণফুলী ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে, আমাদের অদূরদর্শী পদক্ষেপ ও গাফিলতির কারণে দেশের এইসব প্রধান নদী আজ হুমকির মুখে। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্রহ্মপুত্র নদ। কয়েক দিন আগে ব্রহ্মপুত্র নদকে নিয়ে একটি নিউজ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। দেখি ব্রহ্মপুত্র নদের ময়মনসিংহ অংশের মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে কিছু লোক প্রতিবাদ স্বরূপ ব্যান্ড সংগীত পরিবেশন করছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে হাঁটুপানিতে সাজানো হয় প্রতীকী মঞ্চ। একটি টেবিলে রাখা হয় কিছু খাবার কিন্তু পানি ছিল না। প্রতীকী এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে তরুণ তরুণীরা যোগ দেন। তাঁদের মুখে বিষাদের ছাপ। মঞ্চের পিছনে নৌকার পালের মতো সাদা একটি কাপড়ে লেখা ‘মৃতের চিৎকার’। জানা যায়, ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দে ব্রহ্মপুত্র নদের জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখ হতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার টোক পর্যন্ত মোট ২২৭ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৪ সালে। প্রথমে খনন করা হয় ময়মনসিংহ নগরের কাছারিঘাট এলাকায়। পরের শুষ্ক মৌসুমেই চর জাগে নদের বিভিন্ন অংশে। অথচ খননের আগে ব্রক্ষপুত্রে কখনো চর পড়েনি এবং এতো কম পানি দেখা যায়নি। এখন শুষ্ক মৌসুমে এখন পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায় নদ। এছাড়া নদের পুরোটা খনন না করে প্রস্থে মাত্র ১০০ মিটার ও গভীরতায় ৬ মিটার খনন করা হচ্ছে। এতে ১০০ মিটারের বাহিরের অংশ অচীরেই দখল হয়ে যাবে বলে প্রতিবাদকারীরা মনে করেন। তরুণদের অভিযোগ, খননের নামে আসলে ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলা হচ্ছে। খনন করে বালু নদের পাড়ে রাখার কারণে সেসব এলাকা অবৈধ দখলদার দের কবলে চলে যাচ্ছে। যার কারণে ব্রহ্মপুত্র নদ এখন মরে গেছে। তারা বলেন, ইচ্ছে করে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থল বা নদের উৎসমুখ খনন না করায় নাব্যতা ফেরেনি ব্রহ্মপুত্র নদে।

শুধু ব্রহ্মপুত্র নদ নয় ফরিদপুরের কুমার নদ খননের বেলায়ও ঘটেছে একই ঘটনা। দখল দূষণ কমিয়ে নাব্যতা ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০১৮ সালে ২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে খননের উদ্যোগ নেয়। গত ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষও হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নদে ১০ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহ সৃষ্টির মাধ্যমে ২৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। যার মাধ্যমে প্রতিবছর ৩৪ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হবে বলেও বলা হয়েছিল।

প্রকল্পের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, কাজ যথাযথভাবে না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি। নদের দখল ও দূষণ তো কমেইনি, উল্টো নদের বুকে বর্জ্য ফেলা বেড়েছে, ফলে ফেরেনি নাব্যতা। এতে ২৫০ কোটি টাকার পুনঃখননের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিছুই অর্জন হয়নি।

ফরিদপুর সদরের ডিক্রিরচর ইউনিয়নের মদনখালী এলাকায় পদ্মা নদী থেকে কুমার নদের উৎপত্তি। ফরিদপুর শহর গড়ে উঠেছে এই নদের দুই পারে। ১২১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গোপালগঞ্জের সেনদিয়া এলাকায় আড়িয়াল খাঁ ও মধুমতি নদীর সংযোগ খাল বিলরুট ক্যানেলে গিয়ে শেষ হয়েছে কুমারের যাত্রাপথ। জানা যায়, ২০১৮ সালে ২১ এপ্রিল কুমার নদ খনন প্রকল্প শুরু হয়। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানা জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় উৎসমুখ মদনখালী এলাকার অন্তত ২০০ মিটার অংশে খনন করা যায়নি। ফলে মাতৃনদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ ঘটানো যায়নি। ফরিদপুর পাউবোর ২০২০ সালের জরিপে কুমার নদের ফরিদপুর সদরে ১ হাজার ৮৮৯ জন দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। ওই বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালায় পাউবো। শহরের বিসর্জন ঘাট বস্তি এলাকায় ৯টি ছাপরা ঘর উচ্ছেদ করে পাউবো অভিযান শেষ করে।

ভাবতে অবাক লাগে দেশের প্রধান প্রধান নদের যদি এই করুণ দশা হয় তাহলে অন্যান্য ছোট নদীগুলোর কী অবস্থা? একটু খেয়াল করলে দেখা যায় দেশের প্রতিটি জেলা শহরের নদীগুলো আজ মৃত প্রায়। একটু বৃষ্টিতে সব শহর নগর জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হয়। অযত্ন অবহেলা ও দখল বাণিজ্যে নদীগুলো আজ সরু নালায় রূপান্তরিত হয়েছে। কোথায় পানি প্রবাহ আটকে গিয়ে মজা জলাশয়ের মত হয়েছে আবার কোথাও নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিটি নদীর উপকুল দখল করে স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে। অথচ এই সম্পদগুলো রক্ষা না করলে আমাদেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এই সহজ বিষয়টি কেন আমাদের সবচেয়ে মেধাবী ও তীক্ষ্ন বুদ্ধি সম্পন্ন কর্তাব্যক্তিদের মাথায় আসে না, সেটি বড় প্রশ্ন? এই যে দেশে পানীয় জলের তীব্র আকাল চলছে, সেটির সমাধান হতে পারে নদীর সচলতার মাধ্যমে। নদীর জল ব্যবহার করে অতি সহজে ও কম খরচে আমরা চাষাবাদ করতে পারি। কিন্তু সে পথে না গিয়ে আমরা ভূগর্ভস্থ পানির উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। আবার কোনো এলাকা খনন বা নদী ভাঙ্গন রোধ করার প্রকল্প নিলে তার কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া না। অথচ গরীব মানুষের কষ্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়। অনেকে বলেন, কেউ একবার নদী ভাঙ্গন রোধ বা নদী খননের কাজ পেলে তার পুরো জীবনের আয় একবারেই হয়ে যায়। যে পরিমাণ ব্লক ফেলার কথা বা যে পরিমাণ ড্রেজিং করার কথা তার হিসাব রাখা সাধারণের পক্ষে কঠিন আর এই সুযোগটা নেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও তদারককারী কর্মকর্তারা। তাই সরকারের উচিত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর খাত হিসাবে চিহ্নিত করে এর যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া।

লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধসিডিএফএ একাডেমি কাপ টুর্নামেন্ট উপলক্ষে মতবিনিময় সভা কাল