আমাদের বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ। অদূর ভবিষ্যতে অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের কৃষিতে পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। রয়েছে সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে প্রচুর কৃষিজমি খোয়ানোর আশঙ্কাও।এ অবস্থায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলায় উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই এবং এ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো বায়োটেকনোলজি বা জৈব প্রযুক্তি। আশার কথা হলো, ধীরগতিতে হলেও জৈব প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন জিন প্রকৌশলসহ জৈব প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের ওপর গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষিতও করে তোলা হচ্ছে। দেশে এখন স্থানীয় পর্যায়ে এককভাবে ও যৌথ আন্তর্জাতিক প্রয়াসের ভিত্তিতে– দুভাবেই কৃষিতে জৈব প্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা চলছে।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে জৈব প্রযুক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছে সরকারও। জিনগতভাবে পরিবর্তিত ফসলের (জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড বা জিই ফসল) গবেষণা ও বিপণন কার্যক্রমকে বেগবান করতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। পাশাপাশি বজায় রয়েছে সরকারি নীতিসহায়তার দিকটিও। বাণিজ্যিক কৃষিতে জৈব প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটানোর বিষয়ে সরকারও বেশ আগ্রহী। উচ্চমাত্রায় ফলনশীল জিই ফসল উদ্ভাবন নিয়ে এখন প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ও কৃষকের ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্য থেকেই বিভিন্ন সংস্থা ও ইনস্টিটিউট এখন এসব গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত ধান, আলু, বেগুন ও তুলার বিভিন্ন জিই ভ্যারাইটি উন্নয়নকে ঘিরেই এসব গবেষণা চলছে। এরই মধ্যে কৃষিতে জিই বায়োটেকনোলজির বেশকিছু সফল প্রয়োগ দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে কৃষি উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জৈব প্রযুক্তি ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় সীমিত সম্পদ ব্যবহার এবং প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
খরা, লবণাক্ততাসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ৪৭ বছরে কৃষির উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বর্তমান কৃষি উন্নয়নের প্রয়োজনে জৈব প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। বায়োটেকনোলজি কৃষি উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
জৈব প্রযুক্তি তথা বায়োটেকনলোজি ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব দিতে বলেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জৈব প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। আমাদের কৃষি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য জৈব প্রযুক্তিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই জৈব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশকে খুবই আক্রমণপ্রবণ হিসেবে ধরা হয়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। উদ্ভাবনী কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় জৈব প্রযুক্তি বিষয়ক সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। খাদ্য উৎপাদন, উদ্ভিদের বংশ বিস্তার, রোগ নির্মূল এবং জীবদেহের রাসায়নিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার কৌশল বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকরা নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে অথবা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ও উৎপাদিত জিই পণ্য বাজারজাত, আমদানি বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেয়া হয় বাংলাদেশ বায়োসেফটি রুলস–২০১২ ও বায়োসেফটি গাইডলাইনস–২০০৭–এর আওতায়। এতে জৈব প্রযুক্তি খাতকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা গেলেও গোটা বিষয়টিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য তা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বলে অভিমত খাতসংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে গবেষণা কার্যক্রমের যথোপযুক্ততা বজায় রাখার জন্যও এ আইনি কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। এছাড়া দেশের জনগণের মধ্যে জৈব প্রযুক্তি ও জিই পণ্য নিয়ে ব্যাপক ভুল ধারণা ও বিভ্রান্তি রয়েছে। যথোপযুক্ত বৈজ্ঞানিক শিক্ষার মাধ্যমে এসব ভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক, আইনপ্রণেতা, ভোক্তা ও কৃষক পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যাপ্ত জ্ঞান ও ধারণা দেয়া প্রয়োজন।