পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, দেশে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েও খুব বেশি সুফল মিলছে না; বরং অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করলেও সেগুলো আবার চালু হয়ে গেছে। দেশে চালু অর্ধেকের বেশি ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই, চলছে ইটভাটা আইন অমান্য করে।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত চার বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ অবৈধ ইটভাটা বেড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ হাজার অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করলেও সেগুলোর ৭৫ শতাংশই আবার চালু হয়ে গেছে। অবশ্য বেসরকারি পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশের বেশির ভাগ ইটভাটা নিয়মবহির্ভূতভাবে চলছে। এসব ইটভাটার কারণে ঘটছে বায়ুদূষণ।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩–এ বলা হয়েছে, বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ। অথচ দেশের প্রায় শতভাগ ইটভাটা এই আইন মানছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। মূলত কৃষিজমির ওপরের উর্বর অংশ কেটে ইট তৈরি হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়ের জন্য পার্টিকুলেট ম্যাটার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইটভাটা থেকে নির্গত এই দূষিত উপাদান মানবদেহে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করলে রেসপিরেটরি সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইটভাটার আশপাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। গবেষণায় আরও পাওয়া যায়, বর্তমানে বায়ুতে পার্টিকুলেটস ম্যাটারের উপস্থিতিতে মানুষের মৃত্যুর হার আগের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়ুতে মাত্রাতিরিক্ত সালফার ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতির কারণে মানুষ চোখ, নাক, গলাসহ অ্যাজমাটিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বায়ুতে দূষিত উপাদানের উপস্থিতিতে ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মাত্র ১৫১টি ব্লক ইটের কারখানা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হয়েছে ৮৮টি কারখানা। এসব কারখানা দেশের ইটের চাহিদার ৫ শতাংশও মেটাতে পারছে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুবিষয়ক গবেষক আব্দুস সালাম পত্রিকান্তরে বলেছেন, বায়ুদূষণ কমাতে শুধু ইটভাটা বন্ধ করলে হবে না। নির্মাণকাজের ধুলা ও যানবাহনের ধোঁয়া দূষণের বড় উৎস। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেল থেকে ভবিষ্যতে দূষণ বাড়বে। এসব খাতে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বাড়াতে হবে। আর বিকল্প ব্লক ইটসহ অন্যান্য পরিবেশবান্ধব ইটের কারখানা ও উৎপাদন বাড়াতে হবে।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তাঁর এক লেখায় বলেন, বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে অনেক আবাসিক এলাকায়ও ইটভাটা দেখা যায়। উদ্যোক্তারা আবাসিক জায়গা থেকে ইটখোলাগুলো সরিয়ে নিতে খুব একটা আগ্রহী নন। ফলে দেখা যাচ্ছে, ইটখোলার আশপাশে বসবাসরত মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের জন্য ইটখোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে ইটভাটা থেকে নির্গত দূষিত উপাদানের প্রভাবে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এসব ঝুঁকি রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে তবেই ইট উৎপাদন অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে ইট তৈরি করলে পরিবেশদূষণ হওয়ার আশঙ্কা কম। দেশে এ–সংক্রান্ত আইন ও নির্দেশনাও আছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার কারণে নির্দেশনাগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না। এ জন্য প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো দরকার।