পরিবার ও সম্প্রীতির বন্ধন

বাসুদেব খাস্তগীর | রবিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

এ সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠান। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পরিবারের বিকাশ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সে একাকী বসবাস করতে পারে না। পারিবারিক বন্ধনের যে আবহ সেটা চিরন্তন ও শাশ্বত। একটি পরিবারে একটি শিশু যখন বড় হয়ে উঠে সেই পরিবারের ভালোবাসা ও স্নেহমমতার সম্পর্কটুকু সে চিরকাল হৃদয়ে ধারণ করে। হোক সে একান্নবর্তী পরিবার, ছোটো একক পরিবার বা যৌথ পরিবার। একটি পরিবার মা বাবা ভাই কাকা চাচা বা চাচাতো ভাইবোনদের নিয়ে গড়ে ওঠে। পরিবার হলো মানুষের সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের একটি রূপ এবং এ রূপকে বিশ্বজনীন রূপ বলতে পারি। পৃথিবীতে পরিবারের অস্তিত্ব ও মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ঠিক একই সমান্তরাল রেখায়। পরিবারের আছে নানা প্রকারভেদ। যেমন, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, মাতৃতান্ত্রিক পরিবার, একপত্নীক পরিবার, বহুপত্নীক পরিবার, একক পরিবার, যৌথ পরিবার ইত্যাদি। জন্ম থেকেই আমাদের সাথে পরিবারের পরিচিতি। আবহমান বাংলার এই পরিবার প্রথা বেশ ঐতিহ্যের। বলা হয় একটি পরিবার হচ্ছে একটি শিশুর প্রথম পাঠশালা। সমাজে পারিবারিক বন্ধন নামে একটি কথা প্রচলিত আছে। এ পারিবারিক বন্ধন গড়ে ওঠে স্নেহ ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধার নানা উপাদানে। সমাজে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির পারিবারিক ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। সমাজে আত্মীয়তা বা বিভিন্ন সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এ পারিবারিক ঐতিহ্যকে নানাভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজকাল পরিবারের মধ্যে সুন্দর পারিবারিক বন্ধনের বড়ই ঘাটতি।

বর্তমান সময়ে পরিবারের সুন্দর বন্ধন নানা কারণে ভেঙে পড়ছে। ফলে সমাজে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি হচ্ছে। এ অস্থিরতা তৈরির আরো অনেক কারণ আছে। তবে পারিবারিক বন্ধনের ক্ষণভঙ্গুরতা সেই অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন। মানুষের জীবনটাই আসলে তার পরিবার ও সমাজ নিয়ে। সমাজের নানা বিষয়-আশয় নিয়েই তার জীবনের গল্প রচিত হয়। জীবনের সেই গল্প কখনও কল্পনাপ্রসূত কোনো রূপকথার কাহিনি নয়। বাস্তবতার বিচিত্র ঘাত-প্রতিঘাতে তার জীবন উপাখ্যান নানা সুখ-দুঃখের ঘটনা প্রবাহে ভরা থাকে। সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার হচ্ছে সমাজের শিকড়ের অংশ। সমাজের অংশ হিসাবে তাকে বসবাস করতে গিয়ে নানা অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয় এবং এই সম্পৃক্ত থাকার বদৌলতে তার সাথে নানা ধরনের শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে একটা সামাজিক বন্ধনের ভিত রচিত হয়। এই ভিত মানুষকে এক ধরনের আত্মমর্যাদায় বেঁচে থাকতে প্রেরণা দেয়। জীবনে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য একটি প্রশান্তিময় সুনিবিড় দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন অতীব প্রয়োজন। সুন্দর ও চমৎকার একটি পারিববারিক বন্ধনে যে শিশুরা বড় হয়ে থাকে, তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও ধৈর্যশীল মনমানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে। একটি সমাজ ধীরে ধীরে এভাবে মানবিক সমাজে পরিণত হয়। শিশুরাইতো আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

তাদের মধ্যে একটি চমৎকার পারিবারিক বন্ধনের ইতিবাচক দিকগুলো যদি শিশুবেলায় রচিত হয় তার সুদূরপ্রসারী ভালো ফল সুনিশ্চিত। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মধ্যে বসবাস করার যারা আনন্দ খুঁজে পান তারা সহনশীল ও আনন্দময় জীবনের বৈচিত্র্য খুঁজে পান। মানুষের জীবনকে বর্ণিল সুন্দর, পরিশুদ্ধ এবং অর্থবহ করে তুলতে পারিবারিক বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বজুড়ে এই পারিবারিক বন্ধন নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে এবং বহু লেখালেখি হয়েছে। অনেক খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী এবং গবেষকদের নানা গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, পারিবারিক ও সামাজিক একাত্মতা বা সুন্দর সামাজিক বন্ধন একজন মানুষকে সুস্থ ও সুন্দর জীবনের পথে পরিচালিত করে এবং সে মানুষ একজন সহমর্মী সংবেদনশীল মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ হিসাবে সমাজে পরিগণিত হন। সুতরাং আমাদের সকলেই উচিত পরিবারের ছোটখাটো ভুল-ত্রুটিগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে একটু উদার মনমানসিকতা ও হীনমন্যতা পরিত্যাগ করে যথাসম্ভব একটি পারিবারিক আবহের মধ্যে দিনযাপনের চেষ্টা করা। একটি পরিবারে সবাই একরকম মনমানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হন না। তবুও সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে হয়। কারো কারো আচরণের কারণে এই সুন্দর পারিবারিক আবহ বিনষ্ট হতে দেখা যায়। যার সুদূরপ্রসারী ফল অত্যন্ত নেতিবাচক সকলের জন্য। একসময় এসে সে অনুভূতি হয়তো কারো জাগ্রত হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে মা-বাবা দাদা-দাদী আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলেই তো আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা।

এখানে নিজেকে মিলেমিশে থাকার সাধ্যমত অভ্যস্ত করে তোলাই হচ্ছে কৃতিত্ব। কিন্তু সেখানে ছন্দপতন বর্তমান সময়ের একটি নিদারুণ চিত্র। নানা ঘটনা প্রবাহ, আত্মবিশ্বাসের, অভাব কিংবা স্বার্থপরতার মত ঘটনাগুলো পারিবারিক বন্ধনকে ক্ষণভঙ্গুর করে তোলে। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে সুন্দর পারিবারিক বন্ধন ঘরে ঘরে বিরাজমান ছিলো বর্তমান সময়ে এসে তার উপস্থিতি অত্যন্ত প্রকট। এ প্রকটের কারণে সমাজে নানা অস্থিরতা। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে তার শিকড় কিন্তু কোনো না কোনো পরিবারের নানা অস্থিরতা বা সুন্দর বন্ধন ছিন্ন করার ফল হতেই পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রত্যেক মানুষের জীবনে শান্তির অনাবিল উৎস হচ্ছে পরিবার নামক একটি বন্ধনের ঐতিহ্য। পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে কোনোভাবে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যে পরিবার নিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিনিয়ত পথ চলা সেই পরিবারে আমাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা যদি সকলেই পরমতম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিই কিংবা পারস্পরিক বোঝাপড়াটা যদি শ্রদ্ধার আসনে অবিচল থাকে তাহলে কোনো বাধাই সেখানে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না। মানব সভ্যতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সমাজে যে বিবর্তন ঘটেছে তা কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতারই ফসল।

সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে পরিবার। এই পরিবারে থেকেই সমাজের অগ্রযাত্রা। সমাজে যে সুশীল সমাজের কথা বলা হয় সেটা পরিবার থেকেই আসে। কিন্তু বর্তমান সময়ের একটি অনিবার্য সত্য হচ্ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব বিরোধ ও অসহিষ্ণুতার মাত্রা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সে প্রকটতা থেকে যেন আমাদের নিস্তার নেই। ফলে সমাজ ও পরিবারের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা যেন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এ জায়গা থেকে বের হতে হলে আমাদের পারিবারিক বন্ধন সুদূঢ় করা প্রয়োজন। পরিবার প্রথা হাজার বছরের ঐতিহ্যের একটি সংগঠন। বলা হয় এটি চিরস্থায়ী সামাজিক সংগঠন। পৃথিবীর বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বা পথচলায় সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছুরই বিলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু কিছু বিষয়ের বিলুপ্ত ঘটেনি। পরিবার সে ঐতিহ্যেরই একটি প্রতিষ্ঠান। সে পরিবার প্রথার অন্তরালে যে পারস্পরিক বিশ্বাস, স্নেহ, ভালোবাসা, সম্মান, আস্থার যে বিষয়গুলো জড়িত থাকে এগুলোই পারিবারিক বন্ধনের ভিত্তি। সেই বন্ধনের চিড় মানেই দুর্বল সমাজ ও পরিণামে সামাজিক অস্থিরতা। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য মূল্যবোধের চর্চা করাও আজকাল বেশ জরুরি।

এই সুন্দর পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে যদি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে না পারি তা হলে তার নেতিবাচক প্রভাব সবার ওপর গিয়ে পড়বে। এ দায়ভার সহজেই কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। পরিবারের ঐতিহ্য সম্প্রীতির সম্পর্ক হারিয়ে যাওয়া মানে এক ধরনের হৃদয়হীন মানুষের সৃষ্টি হওয়া। এই ধরনের সন্তানদের মধ্যে মমতার বন্ধন আর বিত্তের বন্ধন এক হয়ে ধরা দেয় না। লেখক প্রবোধ কুমার স্যানাল বলেছেন, ‘দুটি বন্ধন আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে স্নেহ ও সেবার। মানুষের সেবাকে যে অস্বীকার করল, যে মানল না স্নেহের বন্ধন, সে হতভাগ্য বিষাক্ত করে গেল মানব সমাজকে।’ সুতরাং পারিবারিক সম্প্রীতির বন্ধনই হতে পারে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম হাতিয়ার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলেজ শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধশিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ যখন মেলার দখলে