লাইফস্টাইল নিয়ে সারাবিশ্বে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। জীবনযাপনেরও যে একটা বিজ্ঞান আছে, যাকে বলা হচ্ছে সাইন্স অব লিভিং–সেটা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। আগামীর চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে সেটা আরো বেশি গুরুত্ব বহন করবে। তাই এই বিষয়ে গবেষণার শাখা–প্রশাখাও বিস্তৃত হচ্ছে বহুগুণে। তেমন একটি গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া। যাতে দেখা গেছে, পরিবারের সঙ্গে বসে খাবার খেলে শিশু–কিশোরদের পরীক্ষার ফলাফল ভালো হয়!
বাসার সবাই একসঙ্গে খেতে বসা মানুষের জীবনেরই একটি অংশ ছিল। তবে বাড়িতে একসঙ্গে খাওয়ার প্রবণতা বর্তমানের ছেলে–মেয়েদের মধ্যে নেই বললেই চলে। এর কারণ হতে পারে তাদের বাইরে থাকা। সারাদিন শেষে রাতে বাসায় ফিরেও থাকে যে যার মতো। খাবার টেবিলে বসে খাওয়া যেনো সব থেকে অপছন্দের একটা কাজ তাদের কাছে। খাবার নিয়ে চলে যায় টিভি, ল্যাপটপ বা মোবাইলের কাছে। খাবার পছন্দ না হলে অর্ডার করে এনে খায়! আর এতে করে দূরত্ব বাড়ে সন্তানের সঙ্গে বাবা–মায়ের।
সমপ্রতি একসাথে বসে খাওয়ার বিশেষ উপকারিতা খুঁজে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়ার গবেষকেরা। যেসব শিশু পরিবারের সঙ্গে বসে নিয়মিত খাবার খায়, তারা অন্যদের চেয়ে পড়াশোনায় ভালো করে। পরিবারের সঙ্গে খাওয়া–দাওয়ার ফলে শিশুদের বেশ কিছু দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। যেমন–আবেগ নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগের দক্ষতা ও শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হওয়া। খাবার টেবিল ভদ্রতা ও পারিবারিক মূল্যবোধ শেখার দারুণ স্থানও বটে। খাবার টেবিলে পরিবারের সবার সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা হলে অনেক বদভ্যাস থেকেও দূরে থাকা যায়।
এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, শিশুর শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ‘ন্যাশনাল সেন্টার অন অ্যাডিকশন অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ’ কয়েকজন টিনএজারের ওপর গবেষণাটি চালায়। অংশগ্রহণকারী টিনএজাররা নিয়মিত তাদের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খায়, সপ্তাহে পাঁচ দিন কিংবা তারও বেশি।
গবেষণাটিতে দেখা গেছে, এই টিনএজাররা তাদের বাকি সহপাঠীদের চেয়ে বেশি ‘এ গ্রেড’ পেয়েছে। পিছিয়ে থাকা সহপাঠীরা এগিয়ে থাকাদের তুলনায় পরিবারের সঙ্গে বসে তুলনামূলকভাবে কম খাওয়া–দাওয়া করেছিল।
গবেষকদের ধারণা, একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে। এখন চারপাশে কেবলই প্রতিযোগিতা। ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণই ক্লাস, কোচিং, অ্যাসাইনমেন্ট, বাড়ির কাজ নিয়ে অস্থির। আছে শিক্ষা কার্যক্রম। ‘তোমাকে সেরা হতেই হবে’–এই চাপও থাকে সব সময়। সারা দিনের এই দৌড়ের পর ডাইনিং টেবিল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের দম ফেলার জায়গা। সেখানেই তারা মানসিক সমর্থন খুঁজে পায়। পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতা অনুভব করে।
একসঙ্গে বসে খাওয়ার এই উপকারিতা শুধু পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। খাবার টেবিলে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। শিশু–কিশোরেরা প্রশ্ন করার এবং মা–বাবার কথা শোনার সুযোগ পায়। বাড়ির সদস্যরা নিজেদের সারা দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। নিজেদের মূল্যবোধ এবং একে অন্যের কাছে তাদের প্রত্যাশা নিয়েও আলোচনার সুযোগ পান। এতে শিশুরা চিন্তা করতে শেখে। নিজেদের ভাবনা মা–বাবার কাছে প্রকাশেরও সুযোগ পায়। এসব আলোচনার ফলে তারা দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে শেখে, সেটা হোক বাড়ি কিংবা ক্লাসে। প্রতিদিনের আলোচনার এই অভ্যাসে শিশু সুন্দরভাবে, গুছিয়ে কথা বলতে শেখে। এই গুণ পর্যায়ক্রমে ভালো ফলাফলের দিকে তাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়।
খাবার টেবিলে একটি নিরাপদ ও আন্তরিক পরিবেশে নিজেদের চিন্তাভাবনাগুলোকে শিশুরা গুছিয়ে প্রকাশ করতে শেখে। অনেকের মাথায়ই অনেক ভালো ভালো আইডিয়া আসে। কিন্তু শুধু গুছিয়ে প্রকাশ করতে না পারায় সেসব আইডিয়া কোনো দিন বাস্তবায়ন করা হয় না। নিজের কাজকে সঠিকভাবে উপস্থাপন না করতে পারার কারণে অনেকে পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে ব্যর্থ হন। তাই ছোটবেলা থেকেই গুছিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে পারা ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করলে মা–বাবার সঙ্গে সন্তানদের বন্ধন দৃঢ় হয়। তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে।
গবেষণাটিতে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে খেতে বসা অনেক বদভ্যাস থেকে দূরে রাখে। যেমন কিশোর বয়সে ধূমপান, মদ্যপান ইত্যাদি। মা–বাবা উপস্থিতি ও নজরদারি এসব ক্ষেত্রে একটি রক্ষাকবচের মতো কাজ করে। ২০১৫ সালে ক্যানাডিয়ান সমীক্ষকদের একটি রিভিউ থেকে জানা যায় যে, পরিবারের সঙ্গে বসে আহার গ্রহণ করলে কিশোরদের খাবারের বিশৃঙ্খলা, মদ্যপান ও অনুপযুক্ত খাদ্যবস্তুর সেবন, হিংস্র ব্যবহার, অবসাদ এবং আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনা প্রতিরোধ করা যায়।
আমরা দেখেছি, এক সময় ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়েছে খুব কম। কিন্তু এখন প্রায়ই যেতে হয়। এমনকি ঘনঘন সন্তানকেও নিয়ে যেতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের একটাই কথা, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে হবে।
একসঙ্গে না খাওয়ার ফলে শরীর ও মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে থাকছেন কমবেশি সবাই। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এভাবে মানসিক চাপে থাকলে মানুষের হৃদ্রোগ ও স্ট্রোক হতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক গবেষণা মতে, এ চাপ কমানোর একটি পন্থা পরিবারের সবাই একটা নির্দিষ্ট সময় একসঙ্গে কাটানো। হতে পারে সেটা একসঙ্গে বসে খাওয়া।
মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক মিশেল পোল্যান তাঁর ‘কোকড’ বইয়ে লিখেছেন, বাড়ির বাইরে খাবার খাওয়ার দুটি খারাপ দিক আছে। প্রথমত, এসব খাবার অস্বাস্থ্যকর। আর অপরটি হলো একাকিত্ব। খাবার টেবিল মূলত সবাইকে একত্র করার জায়গা। সবাই মিলে খাবার খাওয়ার মানে হলো কথা বলার সুযোগ। যেখানে সবাই তাদের কাজকে এক পাশে রেখে একটি ভালো সময় কাটায়। সাধারণ স্বাস্থ্য ও ফিটনেসের পাশাপাশি খাবার টেবিলে সামপ্রতিক ঘটনাবলীর বিষয় কথোপকথন তাদের সমৃদ্ধ করে তোলে এবং তাদের যোগাযোগের স্কিল বাড়ায়।
বিশেজ্ঞরা আরো কিছু কারণ দেখছেন। যেমন– সবাই মিলে একসঙ্গে না খেলে, বার বার খাবার গরম করার সম্ভাবনা দেখা দেয়, ফলে খাবারের খাদ্যগুণ অনেকটা কমে যায়। রান্না করার সময়ে এমনিতেই খাদ্যগুণ কমে ২৫ শতাংশ। এর পরে সেই খাবার ফ্রিজে রাখলে আরও ৫ শতাংশ কমে খাদ্যগুণ। তার পরে আবারও গরম করলে খাদ্যগুণ কমে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ!
একসঙ্গে খাবারের অভ্যাস থাকলে জীবনযাপনে অনেক বেশি শৃঙ্খলা আসে। কারণ এর জন্য নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফিরতেই হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়। পরিবারের সঙ্গে খাবার গ্রহণের অভ্যাস থাকলে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত বাইরে খাওয়ার ঝোঁকটা কমে। পৃথিবীজুড়ে সমস্ত নিউট্রিশনিস্ট ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞদের এই ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই যে বাড়ির খাবারই নিয়মিত খাওয়া শরীর–স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
একসঙ্গে খাবার খাওয়া সামাজিক যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। প্রতিদিন অন্তত একবেলার খাবার পরিবারের সঙ্গে খাওয়া উচিত। এখনকার চ্যালেঞ্জিং পৃথিবীতে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার সময় বের করা হয়তো অনেকের জন্যই দুরূহ। কিন্তু এই কাজ নিয়মিত করতে পারলে সন্তান শিক্ষাদীক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। একসঙ্গে খাবার খাওয়া শুধু শরীরেই পুষ্টি জোগায় না, মন ও মস্তিষ্কের খোরাক হিসেবেও খুবই জরুরি।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)











