পরিবারহীন বলে কোনো শিশু যেন ভালোবাসাহীন না হয়

ঘাসফুলের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সৈয়দ মামুনূর রশীদ | শুক্রবার , ৩০ মে, ২০২৫ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার এক নিভৃত গ্রামউত্তরবাড়ি। ধুলোমলিন পথের শেষ প্রান্তে, নিঃশব্দে শুরু হয়েছে এক মানবিক বিপ্লবের যাত্রা ‘ঘাসফুল ফস্টার চিলড্রেন কেয়ার সেন্টার’। এটি কোনো প্রচলিত এতিমখানা নয়, বরং বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পারিবারিক ফস্টার কেয়ার মডেল। এখানে শিশুরা বেড়ে উঠছে ভালোবাসা, স্নেহ ও নিরাপত্তার ছায়ায়। কোন প্রাতিষ্ঠানিক চার দেয়ালের মধ্যে নয়, বরং বেড়ে উঠছে পরিবারের উষ্ণ বন্ধনে।

ব্যতিক্রমধর্মী মডেলটির সূচনা হয় ২০২৪ সালের ১২ মার্চ, মাত্র ১০ জন অনাথ শিশুকে আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে। ঘাসফুলের এই উদ্যোগের মূল দর্শনএকটি শিশুর সবচেয়ে বড় অধিকার হলো একটি পরিবার। সেই ভাবনা থেকেই অনাথ শিশুদের কোনো আবাসিক কেন্দ্রে নয়, বরং নির্বাচিত ও প্রশিক্ষিত পালক পরিবারের কাছে লালনপালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এখানে প্রতিটি শিশুই একেকটি পরিবারে বড় হয়ে উঠছে যেখানে তারা পাচ্ছে মায়ের মমতা, বাবার স্নেহ, ভাইবোনের সাহচর্য এবং একটি নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার পূর্ণ সুযোগ।

মানবিক উদ্যোগটি কেবল আশ্রয় নয়, শিশুদের সম্মানের সঙ্গেও বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করছে। এখন পর্যন্ত ১৫ জন শিশু৫ জন ছেলে এবং ১০ জন মেয়ে১৫টি পালক পরিবারে অবস্থান করছে। শুরুতে ছিল ৪ জন ছেলে ও ৬ জন মেয়ে। পালক পরিবারগুলোকেও ঘাসফুল প্রশিক্ষণ ও মানসিক প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে তৈরি করেছে, যেন তারা অভিভাবকহীন শিশুকে নিজের সন্তানের মতো গ্রহণ করতে পারে। পালক পরিবারগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে তারা যেন অনাথ শিশুগুলোর উপর মানবিক, সহনশীল ও যত্নশীল হয়ে ওঠে।

শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে ঘাসফুল প্রদান করছে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা যাতে নিশ্চিত হয় শিশুর খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকার। রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠ সহায়তা কেন্দ্র, যেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের মাধ্যমে শিশুরা পাচ্ছে পাঠসহায়তা, সৃজনশীল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সুযোগ।

শুধু পাঠভিত্তিক শিক্ষা নয়, এই সেন্টারের আরেকটি অনন্য দিক হলো লাইফ স্কিল প্রশিক্ষণ। দক্ষ প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে। তারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রমে। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে আর স্বাধীনতায় ভরপুর প্রতিটি দিনই যেন হয়ে উঠছে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার অনুপ্রেরণা।

এ মানবিক বিপ্লবের নেপথ্যে আছেন এক নিরলস কারিগরপ্রবাসী উন্নয়নচিন্তক ও সমাজসেবী নেজবাথ মাসউদ। শুরু থেকেই ঘাসফুল ফস্টার চিলড্রেন কেয়ার সেন্টারের পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি যুক্ত। পর্দার আড়ালে থেকে প্রতিটি ধাপে দিয়েছেন নির্দেশনা। তাঁর বিশ্বাস, ‘প্রতিটি শিশুর বেড়ে ওঠা উচিত এমন একটি পরিবারে, যেখানে তারা অনুভব করতে পারে ‘আমিও কারো সন্তান।’ এই ভাবনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর অন্তরের মমতা ও মানবিক দায়বদ্ধতা।

নেজবাথ মাসউদ দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও তাঁর হৃদয়ের টান ছিল এই দেশের শিশুদের প্রতি। আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি বিশ্বাস করেনশুধু পরিবারভিত্তিক স্নেহময় পরিবেশই পারে একজন শিশুর আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করতে। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি যুক্ত হয়েছেন ঘাসফুলের সঙ্গে এবং যুক্ত হয়েছেন ফস্টার কেয়ারের এক নতুন ধারায়।

বর্তমানে সেন্টারটি এক বছর পূর্ণ করেছে। এই এক বছরে পালিত ১৫ জন শিশুর জীবনে ফিরেছে আশ্রয়, ভালোবাসা ও নিরাপত্তাযা কেবল একটি পরিবারই দিতে পারে। এ সাফল্যের পেছনে যেমন রয়েছে ঘাসফুলের নিবেদিত প্রচেষ্টা, তেমনি রয়েছে নেজবাথ মাসউদের আন্তরিক অনুপ্রেরণা।

সমপ্রতি সেন্টারটি পরিদর্শনে এসেছিলেন ঘাসফুলের সিইও জনাব এ. আর. জাফরী। এটি কেবল রুটিন পরিদর্শন ছিল না বরং একটি হৃদয়স্পর্শী, আবেগঘন বিকেল। শিশুরা তাকে ঘিরে ধরে গান গায়, গল্প করে, কেউবা নিঃশব্দে হাত ধরে ভরসা চায়। সেই বিকেল হয়ে ওঠে এক অনন্য মানবিক মিলনমেলা, যেখানে অনাথ শব্দটি মুছে গিয়ে প্রকাশ পায় নতুন এক আত্মিক বন্ধন। জনাব জাফরী সেদিন বলেন, ‘শিশুদের হাসিমাখা মুখগুলোর মাঝেই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। পরিবারহীন বলে কোনো শিশু যেন ভালোবাসাহীন না হয়এটাই ঘাসফুলের চেষ্টার মূলমন্ত্র।’

এই প্রয়াস কেবল দায়িত্ব পালনের এক দৃষ্টান্ত নয়, বরং এটি আনন্দেরও উৎস। গত পহেলা বৈশাখে শিশুরা সেজেছিল রঙিন বৈশাখি পোশাকে, দিন কাটিয়েছিল গাননাচে, খেলাধুলা আর প্রিয় খাবারের সঙ্গে। ঈদের সময় তারা নিজেরাই শপিং করে, নিজের পছন্দের জিনিস কিনে যা তাদের মধ্যে গড়ে তুলছে স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ।

ব্যতিক্রমী উদ্যোগটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ঘাসফুল এখন পরিকল্পনা করছে ‘ব্যক্তি দাতা ফোরাম’ গঠনের যেখানে সমাজের সহৃদয় ও সামর্থ্যবান মানুষদের সম্পৃক্ত করে গড়ে তোলা হবে একটি টেকসই সহায়তা কাঠামো।

ঘাসফুল ফস্টার চিলড্রেন কেয়ার সেন্টার’ কেবল একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি মানবিক দর্শন যা বিশ্বাস করে, ভালোবাসা থাকলে সমাজের যেকোনো প্রান্ত থেকেও গড়ে তোলা যায় একটি নিরাপদ, স্নেহময় পরিবার।

এখানে আশ্রিত শিশুরা শুধু টিকে নেই, তারা গড়ে তুলছে স্বপ্ন, সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে একটি নতুন ভবিষ্যৎ। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেএই পৃথিবীটা একদিন তাদের জন্যও নিরাপদ ও সুন্দর হবে। আর ঘাসফুলের নিবেদিত কর্মীরাও কাজ করে যাচ্ছেন সেই বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দিতে যাতে একদিন এই শিশুরাও পায় নিজের একটি সংসার, একটি পরিপূর্ণ পরিবার। বস্তুত ঘাসফুল ফস্টার চিলড্রেন কেয়ার সেন্টার হলো ভালোবাসায় গড়া, মানবিকতায় রচিত এক নতুন ঘর।

লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅকশান গ্রন্থে রয়েছে প্রেমের পরিপূর্ণতা ও প্রতিবন্ধকতার অন্তর্দ্বন্দ্ব
পরবর্তী নিবন্ধস্মৃতির পাতায় প্রফেসর আসহাব উদ্দীন আহমদ