সরকার দেশের গণপরিবহন নেটওয়ার্কের মধ্যে একটি স্মার্ট টিকেট ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ স্মার্ট টিকেট কার্ড দিয়ে ইউটিলিটি বিল, সড়ক ও সেতুর টোল, সুপার মার্কেটের কেনাকাটা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের বেতন পরিশোধ করা যাবে। প্রাথমিক পর্যায়ে একক এই পেমেন্ট ব্যবস্থার সুবিধা শুধু ঢাকার বাসিন্দারা নিতে পারবেন। তবে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এ সুবিধা চালু হবে। বহুমুখী এই কার্ডের নাম হলো ‘র্যাপিড পাস’। এটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারি পরিষেবার বিলও পরিশোধ করা যাবে। গ্রাহকরা তাদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অ্যাকাউন্ট থেকে কার্ডটি রিচার্জ করতে পারবেন। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছেন সরকার। গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার ছোট–বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন মারা যায়। সেই হিসাবে বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল– অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন না চালানো, মাদক সেবন করে যানবাহন না চালানো, দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক ও মহাসড়কে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে বাজার ও দোকানপাট অপসারণ, শহরের ফুটপাত, রাস্তা–ঘাট, ইত্যাদি দখলমুক্ত করা।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বরত সংস্থাগুলোর অনিয়ম, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠন ও সুপারিশ প্রণয়নের চক্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এসবের চেয়েও প্রয়োজন জনবান্ধব পরিবহন কৌশল প্রণয়ন।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রধান কারণগুলো হল; বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, জরাজীর্ণ রাস্তা, ফিটনেস বিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার এবং রাস্তা ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব।
ড. মো. হাদিউজ্জামান ‘অপরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থার বিপদ’ শীর্ষক এক লেখায় বলেছেন, যানবাহন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে একটি শহরের চরিত্র অনুধাবন করা যায়। যে শহর যত উন্নত তার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম তত উন্নত। পরিকল্পিত যানবাহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো শহর উন্নত শহরের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে রাজধানী ঢাকা শহরের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। রাজধানীর জনসংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, রাজধানী শহর ঢাকা যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছে পরিবহন ব্যবস্থা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক এবং যুগোপযোগী হতে পারেনি। বর্তমানে রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা একটি অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দেয়। পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত, সেই সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। সড়ক নির্মাণকারী, যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানকারী ও সড়ক দেখভালকারী সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় না। একটি সংস্থার কাজের সঙ্গে অন্য সংস্থার কোনো বোঝাপড়া নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা নির্মাণ করছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিএ) গাড়ির লাইসেন্স দিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গাড়ি আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। তারা নির্ধারণ করছে শহরে চলাচলের জন্য কতসংখ্যক গাড়ি আমদানি করতে হবে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানে না যে, বিআরটিএর সক্ষমতা কতটুকু আছে। সিটি করপোরেশনের জানার কথা তাদের নির্মিত সড়কের ধারণক্ষমতা কতটুকু। কিন্তু তারা গাড়ি আমদানির বিষয়ে কিছুই জানে না। যেহেতু এই সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই, তাই দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার শহরের রাস্তাগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করছে। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খল পরিবেশে তৈরি হয়েছে। যানবাহন ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সামপ্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবহন ব্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন আমাদের উদ্যোক্তারা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের বড় বাধাও এটি। যানজটের কারণে সেবাগ্রহীতার সময় ও ব্যয় বাড়ছে। দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগে ব্যয় বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত বেশি। জ্বালানি অপচয়ের হারও বাংলাদেশে বেশি, মানহীন সড়কের কারণে উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, লাইফটাইম পার হওয়ার আগেই চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়ছে পরিবহন। তাই পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।