এখন বেশিরভাগ মানুষ টিভি দেখে না, দেখে মোবাইল। একসাথে পরিবারের লোকজন ভাত খায় না, মোবাইল দেখে দেখে ভাত খায়। ভালো বই পড়ে না, মোবাইলে ম্যাসেজ করে, অন্যের পোস্ট দেখে হাসে। কার পোস্টে ভুল হয়েছে, কোথায় সংঘাত হলো, কোথায় কার খারাপ কিছু লেখা হলো সেগুলো পড়ে আর কমেন্ট করে। ছোট বাচ্চারা আর কবিতা শুনে মায়ের গল্প শুনে ভাতও খায় না ঘুমায়ও না। বরং ঠাকুরমার ঝুলি গল্পগুলো এখন পুরাতন এগুলো এখন চলে না। মোবাইলে কার্টুন দেখতে ভালো লাগে ওদের। ভাত মুখে রেখে ঘন্টা পার করে দেয় শুধু মোবাইল দেখতে দেখতে। মোবাইল কেড়ে নিয়ে ফেললে শুরু হয় কান্না আর খাব না বলে জেদ। তাই বাধ্য হয়ে আবার দিতে হয়। এটা তো গেলো ছোটদের পরিবর্তন। বড়দেরও দ্রুত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
কেমন যেন সম্পর্কগুলোতে ভালোবাসা নাই, কারো প্রতি সম্মান নাই,মান্য গণ্য করে না কেউ কাউকে, কারো কথা কেউ শোনে না, সবার মধ্যে একটা চঞ্চলতা ও অস্থিরতা কাজ করছে। নিজেকে সবাই এখন বড় একজন ভাবতে শুরু করেছে। পরিবারের বন্ধন বলে আর কিছু থাকছে না। সামান্য বিষয় নিয়েও কথা কাটাকাটি হচ্ছে অহরহ। পরিবার ভাঙছে অনেক বেশি। ডিভোর্স হচ্ছে নতুন দাম্পত্য জীবনে বেশি পরিমাণে। মানিয়ে নিতে পারে না কেউ কাউকে। সামান্য সেক্রিফাইসও করে না এখন কেউ। বন্ধুত্বের জন্য কেমন নষ্ট করছে জীবন। আবার সেই বন্ধুত্বও বেশিদিন টিকে থাকছে না।
পড়ুয়া যারা, তারা পড়ালেখা করতে চাইছে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। অল্পকাজ করেই সফলতা চায় এখনকার ছেলেমেয়ে। না পড়ে যদি পাশ করা যেতো সেটা হতো সবচেয়ে বেশি ভালো এই রকম অবস্থা। শিক্ষকদের প্রতিও কোন শ্রদ্ধা, সম্মান নেই। পরিশ্রম করা তো ওদের মোটেও ভালো লাগে না। বরং এখন সকলের চাহিদা বেড়েছে প্রচুর।বাবার সামর্থ্য আছে কিনা সেটা না দেখে শুধু টাকা চাওয়া, বিভিন্ন জিনিস কেনা। নিজের প্রতি, বা নিজের ভালো থাকাটাই এখন শুধু লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বিবাহিত জীবনে মেয়েরা শুধু স্বামীকে নিয়ে একা থাকতে চাই। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ননদের সাথে মানিয়ে চলতে পারে না আবার চাইও না। বরং উল্টো শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করতে হয় নতুন বৌমাদের।বর্তমান পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
অন্যের সাথে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে সর্বক্ষণ। চারিদিকে শুধু চাই আর চাই। আরো দাও, আরো দাও, আরো চাই, সব চাই।
কিশোর কিশোরীরা প্রচুর ঘুমায়,পছন্দ মতো খাবার চাই ও তা পেলেই খায়, নয়তো বাইরে হোটেলে গিয়ে খায়, আরো দামী মোবাইল চাই,আরো বেশি কিছু উপহার চাই ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাবা মায়ের প্রতি কোন সম্মান দেখানো নেই।এত এত চাহিদা যে পূরণ করে তাও তারা বাবা মায়ের প্রতি কোন সম্মান দেখায় না।বরং উল্টো বলে, এটা তো বাবা মায়ের দায়িত্ব সন্তানদের প্রতি। কৃতজ্ঞতা বোধ উঠে গেছে অনেকের। কারো সামনেও বিনয় ভাব দেখায় না। ঘরে কে আসলো বা মুরুব্বিদের সম্মান জানানো উচিত কিনা এসব এখন বাচ্চাদের মনে থাকে না। বলে দিলে তারপর করে। উপদেশও শুনতে চায় না। সবাই বেশি বোঝে বেশি জানে, তাই কারো উপদেশ মেনে কেউ চলে না এখন।
এই উচ্ছৃঙ্খল মানুষ জাতি কোথায় যাবে? কিভাবে মঙ্গল হবে সবার? সবাই কি অতলে তলিয়ে যাচ্ছে? কথায় কথায় মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে কিশোর কিশোরীরা আত্মহত্যা করে,আর কেউ কেউ হুমকি দিয়ে বাবা মাকে জিম্মি করে রাখছে ঘরে। সন্তান যা চাই তাই দিতে হবে তাদের । এই অনিয়মগুলো কেন হচ্ছে? অনেকে বলবে একজনের দেখাদেখিতে অন্য জন করছে। বন্ধুদের সাথে মিশে নষ্ট হচ্ছে।এটা কি সঠিক? কিছুটা ঠিক হলেও কিছুটা ভুল আছে।
কেন কেউ নিজেকে অন্যের কথায় পরিচালিত করবে? মানুষ কি নিজের বুদ্ধি, নিজের চিন্তা চেতনা কাজে লাগাতে পারছে না? সকলে বলবে এই মোবাইল সব নষ্টের মূল। আসলে মোবাইল কিছুই করেনি।বরং মানুষই মোবাইলকে নিয়ে যত বাজে কজে লিপ্ত।
খেয়াল করে দেখুন মোবাইল কিন্তু একটা যন্ত্র। তাকে চালালে চলে নয়তো পড়ে থাকে। মোবাইলে ভালো যেমন আছে তেমনি খারাপ দিকও আছে। মানুষ এবার এই যন্ত্রটার থেকে যেটা নিতে চায় তাই পায়, তাহলে এতে মোবাইলের দোষটা কোথায়? ইন্টারনেটের এই দুনিয়ায় মোবাইল দিয়ে অনেক বেশি দ্রুত কাজ করা যায় ঘরে বসে। তাহলে মোবাইল তো উপকারীই হলো। আসলে কিছু সংখ্যক মানুষ এর বাজে দিকে লিপ্ত তাই এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। এই মোবাইল নেশাও একদিন কেটে যাবে টিভি দেখার নেশার মতো। কিন্তু তখন কি দেখবে সবাই?
মানুষ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। বিবেকবোধ, নৈতিকতা সততা আরো কত কিছু হারিয়ে ফেলছে। কোথায় যাচ্ছে সবার মন মানসিকতা? সকলের মাঝে এত কিসের ব্যস্ততা? কিসের এই এত বেশি বেশি চাওয়া পাওয়ার হিসেব? অনেক উৎসব অনুষ্ঠান বেড়েছে, বেড়েছে সৌখিনতা, সাজ পোশাক ও নানা ইভেন্ট। নতুনের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে হবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি কিন্তু নতুনকে গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে নয়। কিছু সুন্দর বিষয় প্রকৃতি থেকে আজও আমরা খুঁজে পাই। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া, সূর্য ওঠার রাঙা আলো,সমুদ্রের ঢেউ, ঝর্ণার ধারা, পাহাড়ের সৌন্দর্য, জ্যোৎস্নার রাত, গ্রামের ধানক্ষেতের দৃশ্য এগুলো যেমন কখনো মানুষ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। ভালো খারাপ সবার কাছেই এগুলোর সৌন্দর্য আকর্ষণ করে তেমনি মানুষের ভালো গুণগুলোও অন্যদের আনন্দ দেয়, শিক্ষা দেয় এবং সকলের মনে দাগ কেটে থাকে।
আসুন সকলে মিলে শিশুদের ভালো কাজে লিপ্ত করি, অধিক চাহিদা তৈরি না করি, ধর্মীয় বিধিবিধান তাদের শেখাই। তাহলে আশাকরি ভালো সন্তান, ভালো নাগরিক, ভালো আদর্শ মানুষ গড়ে উঠবেই।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক