করোনা মহামারি আগমনের পর হতে এযাবৎ রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরে শেষ করা যাবে না। এক কথায় যদি বলা হয় তবে বলতেই হবে মহামারিকালে সরকারের সফলতা শতভাগ শূন্য। কেবল আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত আরোপ-নির্দেশ দিয়েই সরকার দায়িত্ব শেষ করেছেন। সেই নির্দেশ মানুষের জন্য কতটা সহনীয় কিংবা আদৌ সহনীয় কিনা? সে বিবেচনা সরকার করেছে বলে অনুমান করা যাবে না। করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য লকডাউন নিশ্চয় অপরিহার্য পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নত সাধন করা ছিল সরকারের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে নৈরাজ্য-দুর্নীতি, অবস্থাপনায় কোনোই নজর দেয়া হয়নি। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয়ে সরকার ন্যূনতম দৃষ্টি দিয়েছে, সেটা ভাবার মোটেও উপায় নেই। তাই জনমনে লকডাউন মানে আতঙ্ক, লকডাউন মানে জীবিকাবিহীন অনাহারী জীবন-যাপন।
একটি রাজনৈতিক বেসামরিক সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এটাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিরস্থায়ী নিয়ম। সঙ্গত কারণে রাজনৈতিক দলের সাথে জনসম্পৃক্ততা অনিবার্য। যে মানুষ তাদের ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করে কিংবা করবে সেই মানুষের স্বার্থরক্ষায় সরকার সর্বাধিক ভূমিকা পালন করবে, সেটাই বাস্তবিক। কিন্তু আমাদের ভোটের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। ভোট এখন আর স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব নয়, ভোট এখন তামাশায় পরিণত। জনগণের ভোটের এখন আর প্রয়োজন পড়ে না। ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়া যায় এবং থাকাও যায়, বাংলাদেশে সেটাই এখন বিদ্যমান। ভোটের কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রক এখন আর জনগণ নয়, আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীই ভোটের কাজটি তাদের ইচ্ছানুযায়ী বাস্তবায়িত করে থাকে, জনগণকে উপেক্ষায়। জনগণের ভোটের যেহেতু প্রয়োজন পড়ে না। সঙ্গত কারণে তথাকথিত ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়ী সরকার জনমুখী না হয়ে জনবিরোধী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সরকার তাই তার প্রকৃত মদদদাতা হিসেবে আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুগত থাকবে, সেটাই বাস্তবতা। আমাদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম নিশ্চয় আমরা আশা করতে পারি না। জাতীয় সংসদে সরকার দলীয় সাংসদ আক্ষেপ করে বলেন, “আমলাদের কারণে রাজনীতিকেরা ম্লান হয়ে যাচ্ছেন। [তোফায়েল আহমদ, ‘দৈনিক আমাদের সময়’, ২৮ জুন, ২০২১]। এতে কী প্রমাণিত হয় না বর্তমান সরকার কত ভয়ঙ্কর রূপে আমলাতন্ত্রের হাতে দেশকে সঁপে দিয়ে গুহায় আত্মগোপন করেছে, করোনা মহামারি থেকে জীবন বাঁচতে। আর আমলারা একের পর এক গণবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেশবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
পূর্বেই বলেছি রাজনৈতিক সরকারকে জনসম্পৃক্ত হতে হয়, নিজেদের স্বার্থে। সেই স্বার্থ পূরণে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সুযোগ যদি হরণ হয়ে যায়, জনগণের প্রয়োজন যদি ফুরিয়ে যায়, তবে জনগণের আর প্রয়োজন কিসে! জনবিচ্ছিন্ন আমলাতন্ত্র, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা তাই প্রবল হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক বা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের আমলা নির্ভরতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তার যেন কোন সীমা-পরিসীমা নেই। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট আছে বলে ধারণা করা যাবে না। আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের কবলে সমষ্টিগত মানুষের এই করোনাকালে চরম ক্রান্তিকাল চলছে। মানুষ যে তার শরীর খাটিয়ে জীবন রক্ষা করবে সেটিও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে অপরিকল্পিত লকডাউন আরোপ করা হয়েছে, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে। সামষ্টিক মানুষের এই চরম সংকটকালে তাদের পাশে না আছে সরকার, রাষ্ট্র, ধনীক শ্রেণি? কেউ নেই। নিরুপায়ে অসহায় মানুষ অন্ধকারে পথ হাতরে অন্ধের ন্যায় ঈশ্বরের কৃপাতেই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বিবেচনা করছে। শেষ আশ্রয় খুঁজছে ঈশ্বরের কাছেই। এছাড়া যে তাদের সামনে জাগতিক বিকল্প উপায়ও আর নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে লকডাউনের ঠিক পূর্বে রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। গত এক বছরের অধিককালব্যাপী করোনার কারণে মানুষের জীবিকা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তিতাস গ্যাস, ওয়াসা, ডিপিডিসি (বিদ্যুৎ বিভাগ), সিটি কর্পোরেশন, ইত্যকার রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো বকেয়াসমূহ হালনাগাদ করতে নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিয়ে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ শুরু করেছিল। তার যে অবসান হয়েছে সেটা কিন্তু বলা যাবে না। যারা ব্যাংক, এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে করোনার প্রথম দু’মাসের লকডাউনে প্রতিমাসের কিস্তি আদায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকেও ভয়ঙ্কর-নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোন প্রজ্ঞাপন-নির্দেশনা জারি না করায় মানুষ ঘরের আসবাবপত্র ইত্যাদি বিক্রি করে ব্যাংক ও এনজিও’র কিস্তি এবং রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানের করের বোঝার দায় মিটিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। প্রবচন আছে, পেটে দিলে পিঠে সয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের শাসনামলে পেট এবং পিঠ দু’টোই পিষ্ট হয়ে মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। একটি রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে এমন নজির দেশে-বিদেশে কোথাও ছিল কিংবা আছে বলে অনুমান পর্যন্ত করা যাবে না। তাই আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদের আক্ষেপটি যে শতভাগ প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবানুগ সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
করোনার টিকাকাণ্ডের জন্য দায়ী যে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় নি। কেননা ব্যক্তিদ্বয় সরকার সংশ্লিষ্ট। তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে সরকার নিজে চুক্তির মাধ্যমে টিকা সংগ্রহ না করে তাদের কমিশনের মুনাফা অর্জনের পথ সুগম করেছে, রাজনৈতিক পক্ষপাতে।
দেশ এখন অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত। সরকার সংশ্লিষ্ট এবং আমলাদের বেসুমার আর্থিক দুর্নীতি এখন আকাশ ছোঁয়া। দেশের অভ্যন্তরে পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতা, শোষণ, নিপীড়নে মানুষ দিশেহারা। প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায় দেশ নিয়ন্ত্রণে একমাত্র আমলা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। একটি বেসামরিক রাজনৈতিক সরকার যে দেশে বহাল আছে তার আলামত কিন্তু আমরা কোন ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি না। তবে কি সরকার নামসর্বস্ব, ক্ষমতা কি হাত-বদলে আমলাতন্ত্রের অধীনে?
বিরাজমান পরিস্থিতিতে করোনার আগ্রাসী তৎপরতা ভারতীয় ভাইরাসের আগমনে আমাদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। ভারতে যখন পথে পথে মানুষ ছটফট করে মারা যাচ্ছিল, অত্যধিক মৃতদেহের সৎকার সম্ভব না হওয়ায় নদীতে লাশ ভাসিয়ে-নিক্ষেপের ঘটনা সারা বিশ্বের শীর্ষ শিরোনামে দাঁড়িয়েছিল, তখন আমাদের অবস্থা জটিল ছিল না। কিন্তু সেই ঢেউ ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ না করে উন্মুক্ত রেখে ভারতীয় ভাইরাসকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। যার খেসারত লক্ষ- কোটি মানুষ দিচ্ছে এখন। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু ওই সকল জেলাগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভঙ্গুর। অঙিজেন, আইসিইউ’র অপ্রতুলতায় প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আমাদের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটাই নিম্নস্তরের যে সেটা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক লেখা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসার নামে মুনাফার অবাধ বাণিজ্য, দুর্নীতি, লুণ্ঠন। তাই করোনাকালের ব্যর্থতার খতিয়ান বিশ্লেষণ করে শেষ করা যাবে না। ব্যর্থতার পাল্লাটা এতই ভারী যে কত বিষয়ে আর প্রতিক্রিয়া জানাবো? প্রতিক্রিয়াও শেষ হবার নয়। সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতার নজির ব্যতীত আমাদের সামনে কোন আশা কিংবা সফলতার নাম-গন্ধ নেই। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এসকল ঘৃণ্য ঘটনাও অপ্রাসঙ্গিক নয়। তাই আমাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তায় বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলের মধ্য দিয়েই কেবল আমাদের পরিত্রাণ লাভ সম্ভব হবে। বিকল্প কোন উপায় কিন্তু আমাদের সামনে নেই।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।