পরিচয় বদল

আজমাঈন আদিল (৩২,১০৭) | বুধবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

যেদিন রোগীর সংখ্যা খুব বেশি থাকে সেদিন তাদের সমস্যাগুলোও খুব অদ্ভুত থাকে। আজ এই লোকটি আরো অদ্ভুত এই কারণে যে তিনি শূন্যদৃষ্টিতে শুধু তাকিয়েই আছেন। কোনো কথা বলছেন না ।

ডাক্তার নাসিম জানেন তিনি দেখতে সুদর্শন। তবে যেহেতু তিনি একজন ডাক্তার কাজেই তাকে বলতে হলো, ‘আপনার অসুবিধাটা কী?’ তবুও কোন সাড়াশব্দ নেই! নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ

অতিরিক্ত অস্বস্তি এখন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নাসিম সাহেবের জন্য। তিনি একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ‘আপনি কী কথা বলতে পারেন না?’

স্যার কথাই তো বলছিলাম এতক্ষণ!’

কার সাথে? মনে মনে?’

জি স্যার নীলার সাথে।’

নীলা! নীলা কে? এখানে তো নীলা বলে কেউ নেই। শুনুন আপনার যা বলার দ্রুত বলুন, আমার সময় খুব কম।

জি, স্যার, জানি। রাত ন’টায় আপনাকে আপনার শ্যালিকার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে থাকতে হবে।’

এখন নাসিম সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। তার এ ধরনের মানুষদের খুব ভয়ঙ্কর মনে হয়। যারা কথা বলে না বলে না কিন্তু আবার যখন বলা শুরু করে তখন আর থামে না । তারা যেন বিদ্রোহী কবির সেই কথাটার মতোআপন হাতের মুঠোয় পুরে পুরো জগৎটাকে দেখে। নাসিম সাহেব আর্তস্বরে বললেন, ‘আপনি এসব জানলেন কী করে? কে বলেছে আপনাকে এসব?’

নীলা’

আচ্ছা আপনি একটু পরিষ্কার করে বলুন তো আপনার অসুবিধাটা কী? আর আপনি কেনই বা এসেছেন এখানে? আমি আপনাকে কী ধরনের সাহায্য করতে পারি?’

আপনি আমার কোন সাহায্য করতে পারেন না। তবে আমি আপনার সাহায্য করতে পারি।’

লোকটিকে এখন যতটা না অদ্ভুত তার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর দেখাচ্ছে। আতঙ্কগ্রস্থ নাসিম সাহেব বললো, ‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটি নাসিম সাহেবকে গ্রাহ্য না করে কথা বলা শুরু করলো, ‘আপনার বাবা আপনার জন্মের পরে নাম রেখেছিল ওয়ালীউল্লাহ। পরে সেটা হয়ে যায় নাসিম শাহ। ওনার নাম বদলানোর স্বভাব ছিল। নাসিম সাহেব কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।

লোকটি দম নিয়ে আবার বলা শুরু করলো, ‘আমার জন্ম ১৯৫০ সালে। এখন ২০২৩।’ লোকটি যথাসম্ভব দম নিয়ে নিলেন। ‘তখন সালটা ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে আগে নীলা নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করি। বিয়ের রাতেই একজন লোক আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে আমার সামনে দিয়ে তুলে নিয়ে গেলেন। তিনি যে রাজাকার ছিলেন তা আমি ওই দিনই প্রথম জানতে পারি। তারপর…’ বলে তিনি থেমে গেলেন। নাসিম সাহেব লক্ষ্য করলেন লোকটির গল্প বলার ক্ষমতা খুব সুন্দর। সামনেই এক গ্লাস পানি রাখা ছিলো, লোকটি পানি খেলেন সেখান থেকে। আবার বলা শুরু করলো, ‘এভাবে তিন মাস কেটে যাওয়ার পরে যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন জানতে পারি নীলা বঙ্গবন্ধুর তৈরি করে দেওয়া শেল্টার হাউজে আছে। মনটা কি যে আনন্দে ভরে উঠলো। কিন্তু আমি তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সাহস পেলাম না। ভাবতে লাগলাম আমি নিজে কি যে অথর্ব! আমার সামনে দিয়ে আমার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গেল আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। লজ্জা এবং অনুশোচনা দুটোই আমাকে ঘিরে ধরেছিল। তবুও সাহস করলাম যে যাই হোক আমি নীলাকে ফিরিয়ে আনবোই। কিন্তু নীলার মৃতদেহটা ছাড়া যে কিছুই ফিরবে না তা আমি কি করে জানতাম?

তিনি কী সুইসাইড করেন’?

হ্যাঁ । আমার এক সপ্তাহ কেটে গেলে উদাসীনভাবে তখন আমি জগৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই’।

লোকটি আবার থামলেন। নাসিম সাহেব তার অঙ্গভঙ্গিমায় এখন তার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছে।

লোকটি সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে বলতে লাগলো, ‘এক সপ্তাহ পর দেখি হঠাৎ নীলা আমার সাথে কথা বলছে। আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি, তবে দেখি সত্যিই নীলা আমার সাথে কথা বলছে। নিলা আমাকে পরামর্শ দিচ্ছে নতুন জীবন শুরু করার। আমি প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারি না আমার সাথে কি হচ্ছে। তারপর আমিও তার সাথে কথা বলতে বলতে আরও উনিশ বছর কাটিয়ে দিই। এখনো আমি তার সাথে কথা বলি। আমি যেখানেই যাই সেখানকার সকল তথ্য সে আমায় বলে দেয়। যেমন একবার একজন লোক আমাকে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে পকেট মারতে চেয়েছিল। নীলা আমায় বলেছিল খাবার না খেতে, আমিও খাই না। লোকটি শেষমেষ রেগে গিয়ে আমার সামনেই আমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে যেতে চায়। চলেও যায়। আর আজকে এখানে আসার আগে আমাকে আপনার সম্পর্কে সব তথ্য দেয়’। এতটুকু বলে তিনি থামেন।

এবার নাসিম সাহেব বললেন, ‘আপনার কথাগুলো অবিশ্বাস্য হলেও বিশ্বাস্য। কারণ আপনি যে রোগের বর্ণনা দিয়েছেন তাকে বলা হয় ‘ডিজঅর্ডার অভ্‌ পার্সোনালিটি’। এক্ষেত্রে একজন মানুষ দুটি ব্যক্তিত্বের মাঝে কাজ করে। তাদের ব্যক্তিত্ব কিছুক্ষণ পরপর বদলে যায়। এক্ষেত্রে যখন মানুষ একটা ব্যক্তিত্বের মধ্যে থাকে তখন আরেকটি ব্যক্তিত্বের কথা মনে রাখতে পারে না। এটির কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। অর্থাৎ আপনার কথার অর্ধাংশ বিশ্বাস করা যায় অর্ধাংশ বিশ্বাস করা যায় না’।

এসব কথা শুনে লোকটি উঠে যেতে উপক্রম হলো। নাসিম সাহেব তড়িঘড়ি করে বললেন, ‘আরে বসুন বসুন না! আরেকটু কথা বলি…’

নাসিম সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা আপনি যে রাজাকার ভাইয়ের কথা বলছিলেন আপনি কি তার সম্পর্কে জানেন? তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন? কী করেন?’

হ্যাঁ, জানি। তার নাম সৈয়দ হাফিজ শাহ। উনি পরিচয় বদল করেছেন।

ওহ…’

হঠাৎ দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। কোন কথা বললো না।

নাসিম সাহেব অনেক চিন্তিত মনে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা আপনার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কী? সেটা তো বললেন না।’

নাসিম সাহেব পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না। সৈয়দ হাফিজ শাহ…, আপনি একটু মনে করে দেখুন তো আপনার বাবার নাম কী’?

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাজায় জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধশরত