পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠন সময়ের দাবি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড

ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ আসিফ | মঙ্গলবার , ১৬ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বিশ্বের কোনো দেশে এ ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটেনি। মহাত্মাগান্ধী হত্যার বিচার করতে লেগেছিল মাত্র ৮ মাস। অথচ আমাদের জাতির জনকের হত্যার বিচার করতে লেগেছে ৩৫ বছর! বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এবং দেশের ভিতরে বহু ষড়যন্ত্র হয়। প্রায় ২২ বছরতো ইনডেমনিটি আইনের মত একটি কালো আইন দিয়ে খুনিদেরকে অব্যাহতি দিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে দেরিতে হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর দৃঢ়তার কারণে দেশের ইতিহাসের সবচে ঘৃণ্যতম এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। সরাসরি জড়িত ১২ আসামির ফাঁসি হয়েছে। এতে কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছে জাতি। কিন্তু এ মামলা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন ক্ষুদ্র আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি এখন সময় এসেছে বঙ্গবন্ধুর খুনের পরিকল্পনায় যারা জড়িত ছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনা। জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক যে এ খুনের মাস্টারমাইন্ড বা পরিকল্পনাকারী ছিলেন তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া আসামি ক্যাপ্টেন মাজেদ চৌধুরী দণ্ড কার্যকরের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনিকে জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনার বিষয়টি স্পষ্ট করে গেছেন। তারা যেহেতু মৃত্যুবরণ করেছেন তাই তারা বিচারের আওতায় আসে নি। যারা এখনও বেঁচে আছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারী ছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রয়োজনে কমিশন গঠন করতে হবে।

আপীল বিভাগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনায় যেভাবে যুক্ত হয়েছি তার একটি বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। ২০০৬ সাল থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনবিশেষজ্ঞ আনিসুল হকের জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করি আমি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার লিভ টু আপীল শুনানি যখন শুরু হল তখন কোনো রকম অফিসিয়ালি নিয়োগ ছাড়াই এ মামলার সঙ্গে যুক্ত হই। ২০০৯ সালে আপীল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ শুনানির সময় সহকারী এটর্নি জেনারেল (স্পেশাল র‌্যাঙ্ক-জি) হিসেবে সরকারিভাবে নিয়োগ পাই। আমাদের টিমের প্রধান এবং নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এছাড়া টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসহ অনেকে। তবে আমি ছিলাম টিমের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য এবং আমার জানা মতে চট্টগ্রাম থেকে আমি ছিলাম এই মামলার আইনজীবী প্যানেলের একমাত্র সদস্য। আপীল বিভাগে শুনানি শুরু হয় ৫ অক্টোবর ২০০৯ এবং ২৯ কার্য দিবস ধরে শুনানি হয়। ২৯ দিন শুনানির পর মাননীয় আপীল বিভাগ আসামিদের আপীল খারিজ করে চূড়ান্ত রায় দেন। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর ঘোষিত রায়ে ১২ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে।

মামলা পরিচালনার সময় আমাদের টিমের লক্ষ্য ছিল আসামি পক্ষ যে সকল গ্রাউন্ডে আপীল করেছে সে সকল গ্রাউন্ড খণ্ডনের জন্য আমাদের উপমহাদেশসহ ইংল্যান্ড এর কোর্টে যে কেস ল (পধংব ষধ)ি আছে সেগুলোর ব্যাপারে অবহিত থাকা এবং মাননীয় বিচারপতিগণের বিবেচনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পিকচার দাখিল করা। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় চেয়েছেন একটি ন্যায় বিচার। তিনি চাইলে আলাদা ট্রাইইব্যুনাল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেন নি। তিনি প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চেয়েছেন। তাই আমরাও আমাদের সাবমিশন- এ কোনো রকম ফাঁক-ফোকর বা ত্রুটি রাখতে চাইনি। আমরা কিছু কিছু ইস্যুতে ২০০/২৫০ বছর পুরনো অর্থাৎ ১৮০০ সালের ‘কেস-ল’ মহামান্য আপীল বিভাগে দাখিল করি। যার কারণে প্রত্যাশিত রায় আসে।

ঐতিহাসিক এ মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকাটাকে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করি। তাছাড়া আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ কারণে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে দায়টা আরও একটু বেশি অনুভব করি। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিল মামলায় তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা পরিকল্পনাকারী ছিলেন, যারা এখনও দম্ভ করে বেড়ান নিজেদের জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে। যারা বলেন, জিয়া পরিবার বা জিয়াউর রহমান যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তাদের পরামর্শ ছাড়া কিছুই করতেন না- এমন নেতা যারা এখনও বেঁচে আছেন, চট্টগ্রামে বা দেশের বিভিন্ন স্থানে, কিংবা দেশের বাইরে তাদের খুঁজে বের করা উচিত। প্রয়োজনে কমিশন গঠনের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করে জবানবন্দি গ্রহণ করা উচিত। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার যে কলঙ্ক তিলক বাঙালির কপালে লেগে আছে তা পুরোপুরি মুছবে। পরবর্তী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর সরাসরি খুনিদের চেনার পাশপাশি চিনবে পরিকল্পনাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদেরও। তখন আর ইতিহাস বিকৃত করার সুযোগ থাকবে না।

এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যেসব আসামি এখনও দেশের বাইরে পালিয়ে আছে তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা জরুরি। কারণ তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তাবে তাদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যেসব দেশে তারা পালিয়ে আছে সেসব দেশের আইনই বড় বাধা হয়ে আছে।

লেখক: সদস্য- কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : অবিনশ্বর ও অমর সত্তা
পরবর্তী নিবন্ধমশিউর রহমান দিদাররের নেতৃত্বে মিলাদ মাহফিল ও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরন