অসম প্রেমের করুণ পরিণতিতে একজন পরপারে, অন্যজন কারাগারে। গত এপ্রিলে সংঘটিত ঘটনাটির রহস্য উন্মোচিত হয়েছে অবশেষে সিআইডির তদন্তে। একটি মোবাইলের প্যাকেট ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে। মিমি আক্তার (২৬) ও পল্লব বর্মণ (৩৪); দুজনই বিবাহিত। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার কালামপুর গ্রামে পল্লবের ফ্ল্যাক্সিলোডের ব্যবসা ছিল। মিমির স্বামী সিঙ্গাপুর প্রবাসী ও তার ছয় বছর বয়সী এক ছেলে আছে। পল্লবেরও স্ত্রী-সন্তান আছে। মিমি পল্লবের দোকানে মোবাইলে টাকা লোড করার জন্য আসতেন। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়। দুই বছর পরকীয়া প্রেম করার পর গত ১৮ জানুয়ারি মিমিকে চট্টগ্রামে এনে বিয়ে করেন পল্লব। প্রথমে তারা নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন সরাইপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। কয়েকদিন সেখানে অবস্থানের পর যান কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে বেড়াতে। সেখানে ২০ দিন অবস্থানের পর দু’জনে আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ১ মার্চ দু’জন নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন আব্দুল আলী সড়কের একটি বাসা ভাড়া নেন।
এরই মধ্যে পল্লব অনুভব করতে থাকেন, মিমির চেয়ে তার প্রথম স্ত্রী-ই ভালো ছিল। ক্ষমা চেয়ে প্রথম স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। মিমি সেটা শুনে ফেলেন। এতে বাসায় ওঠার পরদিন থেকেই তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। মিমি ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেন। এতে দুর্বল হয়ে পড়লে একজন পল্লী চিকিৎসককে বাসায় এনে তার চিকিৎসা করানো হয়। মিমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে দুজনের মধ্যে আবারও ঝগড়া শুরু হয়। মিমির মতে যার জন্য ঘর ছেড়েছেন, সে-ই যদি প্রথম স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে এতসব কেন? আত্মহত্যাও করতে যান একবার। দাম্পত্য কলহ তীব্র হয়ে ওঠে, মাত্র দুই মাসের মধ্যেই প্রেম ছুটে পালায়। প্রথম স্ত্রীর প্রতি পল্লবের টান বাড়তে থাকে, সাথে মাথায় খুন চাপে। প্রথমে পানির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ এবং পরবর্তীতে বেলের শরবতের সঙ্গে কীটনাশক খাইয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে দ্বিতীয় স্ত্রী মিমির। এরপর লাশ বাসায় রেখে দরোজায় তালা দিয়ে পালিয়ে যান পল্লব। পুলিশ যাতে হদিস না পায় সেজন্য স্ত্রীর মোবাইল ফেলে দেন নালায়। প্রায় একমাস পর পাহাড়তলী থানা পুলিশ তালা ভেঙে গলিত লাশটি উদ্ধার করে। ক্লু লেস মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করে সিআইডি। পরে মামলার তদন্ত ভার নিয়ে গ্রেপ্তার করে ঘাতক স্বামী পল্লবকে। তার জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ। আসামিকে গ্রেপ্তারের একমাসের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল করেছে সিআইডি।
সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ আজাদীকে বলেন, লাশটি যখন উদ্ধার করা হয় সেটি চেনার কোনো উপায় ছিল না, এতটা বিকৃত হয়ে গেছে। কোনো ধরনের ক্লুও ছিল না। বাড়ির মালিক বলছিলেন, মাস দেড়েক আগে দু’জন স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বাসাটি ভাড়া নেন। তাদের কোনো ছবি, এনআইডি কিছুই ছিল না। কিন্তু ওই বাসায় আমরা একটি মোবাইলের প্যাকেট পাই। ওই প্যাকেটের সূত্র ধরে আমরা ওই বাসায় অবস্থানকারী একজনের ময়মনসিংহে অবস্থান শনাক্ত করতে পারি। এরপর আমরা পল্লবকে গ্রেপ্তার করি। গ্রেপ্তারের পরই মূলত পল্লব ও মিমির পরিচয় উদঘাটন হয়েছে এবং পুরো ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। তবে এর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে নেশা জাতীয় দ্রব্য ও বিষ খাইয়ে হত্যার বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয় বলে জানান সিআইডি কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ খালেদ।
প্রসঙ্গত, গত ১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টায় নগরীর পাহাড়তলী থানার আব্দুল আলী সড়কে জনৈক নাজির আহমেদের মালিকানাধীন ‘মাধবী ভবনের’ চতুর্থ তলার একটি বাসার তালা ভেঙে অজ্ঞাত নারীর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিনই সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে। আনুষ্ঠানিক তদন্ত ভার পাবার পর আসামি শনাক্ত করে গত ৯ মে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে পল্লবকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ মে আদালতে জবানবন্দি দেন আসামি। ১৪ জুন মামলার অভিযোগপত্র মহানগর আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় জমা দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি, চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন রতন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, গত ৪ মার্চ দুপুরে পল্লব বাসার ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য ওঠেন। সেখানে ছাদ বাগানের জন্য মালিকের রাখা বোতল ভর্তি কীটনাশক তিনি বাসায় নিয়ে আসেন। বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে ১০টি ঘুমের ওষুধ কেনেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে পল্লব পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মিমিকে পানির সঙ্গে ১০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেন। এতে মিমি আরও দুর্বল হয়ে পড়লে তাকে বেলের শরবত খাওয়ানোর নামে এর সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে খাইয়ে দেন। মুখ দিয়ে লালা বের হয়ে যাবার পর পল্লব বুঝতে পারেন, মিমি মারা গেছেন। তখন তিনি মিমির পোশাক ও মোবাইল নিয়ে বাসায় তালা দিয়ে পালিয়ে যান। রাতে সেন্টমার্টিন ট্রাভেলসে চেপে ঢাকার আবদুল্লাহপুর যান। সেখানে মিমির মোবাইলটি একটি নালায় ফেলে দেন। এরপর কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে আবার ময়মনসিংহের ভালুকায় চলে যান।