পৃথিবীতে মুমিনরা মহান আল্লাহকে না দেখেই তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর আদেশ–নিষেধ মান্য করে। বিনিময়ে পরকালে তারা আল্লাহর কাছে বিনিময় প্রত্যাশা করে। পরকালে মুমিনের বিশ্বাস ও আনুগত্যের যেসব পুরস্কার দান করবেন তার ভেতর সর্বোত্তম পুরস্কার হলো মহামহিম আল্লাহর সাক্ষাৎ ও দর্শন। জান্নাতে মুমিনরা আল্লাহকে দেখে তাদের মনোবাসনা পূরণ করবে এবং সর্বোচ্চ পরিতৃপ্তি লাভ করবে। বিপরীতে অবিশ্বাসীরা আল্লাহর সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা ও বিশ্বাস হলো পার্থিব জীবনে মানুষের পক্ষে আল্লাহর সাক্ষাৎ বা তাঁর দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য মুসা (আ.)-যখন হে প্রতিপালক আমাকে দেখা দিন বলে সাক্ষাতের আবেদন করেছিলেন তখন উত্তর দেওয়া হয়েছিল তুমি কখনোই আমাকে দেখতে পারবে না। (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৪৩) তবে পরকালে মুমিনরা আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করবেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে কেয়ামতের দিন বহু মুখমল সজীব ও প্রফুল্ল হবে। তারা নিজ পালনকর্তাকে দেখতে থাকবে।
পরকালে মুমিনের কাছে আল্লাহর সাক্ষাৎ হবে সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। আবু হুরায়রা (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন যখন জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহতাআলা বলবেন তোমরা কি এমন কিছু চাও যা আমি বাড়িয়ে দেব? তারা বলবে আপনি কি আমাদের চেহারা উজ্জ্বল করেননি? আপনি কি আমাদের জান্নাত দান করেননি? আপনি কি আমাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? অতঃপর আল্লাহ তাঁর পর্দাগুলো সরিয়ে দেবেন। জান্নাতিদের আল্লাহর সাক্ষাতের চেয়ে বেশি প্রিয় কিছু দান করা হবে না। জান্নাতে মুমিনরা যখন আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করবে সে সময়ের দৃশ্য হাদিসে খুব সামান্যই বিবৃত হয়েছে। যার কয়েকটি হলো আল্লাহকে দেখা যাবে নির্বিঘ্নে : জারির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.)-থেকে বলেন একবার পূর্ণিমার রাতে নবী (সা.)-আমাদের কাছে বের হয়ে এলেন। অতঃপর তিনি বললেন, শিগগিরই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে কিয়ামতের দিন দেখতে পাবে যেমন এ চাঁদটিকে তোমরা দেখছ এবং একে দেখতে তোমাদের অসুবিধে হচ্ছে না। আল্লাহ কথা বলবেন: আদি ইবনু হাতিম (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে শিগগিরই তার প্রতিপালক কথা বলবেন তখন প্রতিপালক ও তার মধ্যে কোনো অনুবাদক ও আড়াল করে এমন পর্দা থাকবে না।
জান্নাতের নেয়ামত অপরিসীম। আল্লাহতাআলা জান্নাতিদের সকল ইচ্ছা পূরণ করবেন। কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী সেখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। কখনো অসুস্থ হবে না, দুর্দশাগ্রস্ত হবে না, পরিধেয় বস্ত্র কখনো পুরোনো হবে না এবং তার যৌবনও কখনো শেষ হবে না। জান্নাতের সুশীতল ছায়া,আপ্যায়ন, পানীয়, চক্ষু শীতলকারী, পরিবেশকগণ বহুতলবিশিষ্ট সুউচ্চ মনোরম প্রাসাদ বাগান ও ঝর্ণা জান্নাতিদের প্রতি অভিবাদন এবং সবকিছুর ওপরে আল্লাহর সন্তুষ্টি–সকল নেয়ামতে পরিপূর্ণ থাকবেন চিরস্থায়ী জান্নাতিরা। কিন্তু এমন একটি সময় আসবে যখন তারা আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখবেন। হাদিসের বর্ণনামতে সেই মুহূর্তে তারা ইতোপূর্বের সকল নেয়ামতের কথা ভুলে যাবেন। অর্থাৎ একটু আগেও যেসকল নেয়ামত রাজির কারণে জান্নাতিরা সুখি ও আনন্দিত ছিলেন সে সকল নেয়ামতকে আল্লাহর দিদারের তুলনায় ফিকে মনে হবে। ইতোপূর্বে তারা কল্পনাও করেনি যে মহান আল্লাহর দিদার এতটা সুখকর ও প্রশান্তিময় হতে পারে। আদন জান্নাতে সাক্ষাৎ হবে: কায়স (রা.)-থেকে বর্ণিত নবী (সা.)-বলেছেন, দুটি জান্নাত এমন হবে সেগুলোর পানপাত্র ও তার ভেতরের সব কিছুই হবে রুপার। আর দুটি জান্নাত এমন হবে সেগুলোর পানপাত্র ও তার ভেতরের সব কিছুই হবে সোনার। জান্নাতে আদনে তাদের ও তাদের রব্বের দর্শনের মধ্যে তাঁর চেহারার ওপর অহংকারের চাদর ছাড়া আর কোনো কিছু আড়াল থাকবে না। জান্নাতিরা কৃতজ্ঞতায় সেজদা করবে: আলী (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন, (সব ধরনের নেয়ামত লাভের পর) জান্নাতিরা বলবে আমাদের প্রভুর মুখদর্শন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তখন আল্লাহ তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করবেন এবং জান্নাতিরা সেজদায় পড়ে যাবে। তাদের বলা হবে তোমরা আমল করার স্থানে নেই তোমরা রয়েছ প্রতিদান লাভের স্থানে। আল্লাহ কোরআন তেলাওয়াত করবেন: বুরাইদা (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন নিশ্চয়ই জান্নাতিরা প্রতিদিন দুবার মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে প্রবেশ করবে। অতঃপর তিনি তাদের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করবেন।
পরকালে পাপীরাও আল্লাহর সাক্ষাৎ পাবে তবে তারা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের চেহারা দেখবে না। তাদের প্রতি আল্লাহ থাকবেন ক্রোধান্বিত। আবদুল্লাহ (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন যে, ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে কোনো মুসলিমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে সে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে এমন অবস্থায় যে তিনি তার ওপর রাগান্বিত। আল্লাহতাআলা পরকালে তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহারস্বরূপ তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এ সাক্ষাতে চলে অনন্তকাল। তা হবে বান্দার সঙ্গে আল্লাহতাআলার প্রেমের সাক্ষাৎ। আল্লাহতাআলা কিয়ামতের দিন মুমিন বান্দার সঙ্গে যে সাক্ষাৎ দেবেন সে সম্পর্কে তিনি বলেন, যেদিন আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে সেদিন তাদের অভিবাদন হবে সালাম। তিনি তাদের জন্য সম্মানজনক পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন। (সুরা আহজাব: আয়াহ ৪৪)। আল্লাহতাআলা দুনিয়ার ঈমানদারদের সুসংবাদ প্রদানে ইরশাদ করেন আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ আল্লাহর সঙ্গে তোমাদের সাক্ষাৎ করতেই হবে। আর যারা ঈমানদার তাদের সুসংবাদ জানিয়ে দাও। (সুরা বাকারা: আয়াত ২২৩)। আল্লাহতাআলা দিদার লাভ করা সহজ ব্যাপার নয় তাও তিনি কুরআনে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে হে মানুষ! তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে অতপর তার সাক্ষাৎ ঘটবে। (সুরা ইনশিকাক : আয়াত ৬)। অবিশ্বাসীরা সেদিনও শাস্তি হিসেবে আল্লাহর সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ বলেন অবিশ্বাসীরা সেদিন নিজ পালনকর্তার সাক্ষাৎ থেকে আড়ালে থাকবে (বঞ্চিত হবে)। (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১৫)
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-বলেন নিশ্চয়ই অবিশ্বাসীরা আল্লাহকে আপন অবস্থায় দেখবে না তিনি তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করবেন না আবার তিনি তাদের থেকে গোপনও থাকবেন না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাক্ষাৎ বান্দার জন্য সর্বোত্তম পুরস্কার। এ পুরস্কার জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। আয়েশা (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে আল্লাহও তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ অপছন্দ করে আল্লাহও তার সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন। সৃষ্টি এবং স্রষ্টা মুখোমুখি। চোখ বন্ধ করে একটু ভাবি। সারাজীবন দুনিয়াতে যাকে ডেকেছি। যাকে না দেখে চোখ দুটো অঝোরে কেঁদেছে। কাউকে না বলা আমার একান্ত কথাগুলো যাকে বলেছি। খুব বিপদে কেউ নেই পাশে কেঁদে কেঁদে যাকে বলেছি। পকেট ফাঁকা ঘরে খাবার নেই অনিশ্চিত উৎস থেকে খাবারের ব্যবস্থা যিনি করেছেন। কত চাওয়া মাকে বলিনি বাবাকেও না রাতের আঁধারে কেঁদে কেঁদে যাকে বলেছি। কত অপরাধ করেছি কেউ দেখেনি। একজন দেখেছেন কিন্তু গোপন রেখেছেন। বারবার ভুল করেছি যিনি মাফ করে দিয়েছেন অদৃশ্য ইশারায় সাবধান করেছেন। মমতাময়ী মা আমার আদরের সন্তান প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসা দিয়ে অদৃশ্য ভালোবাসায় আমাকে যিনি ভালোবেসেছেন সবচে বেশি। আমার সবচে আপন সুমহান সেই প্রতিপালকের মুখোমুখি, সাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে নবীজী (সা.)-বলেছেন, পৃথিবীতে আমরা যেমন চাঁদকে স্পষ্ট দেখি আমরা আল্লাহ সুবহানুওতায়ালাকে তেমনি দেখব। ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ সবাইকে জান্নাতে প্রবেশ করার, তাঁর দিদার, সাক্ষাৎ ও দর্শন লাভের সৌভাগ্য দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট