ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নগরীতে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদুল আকসা ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপুর্ণ মসজিদ। মুসলমানদের প্রথম কিবলা। এখান থেকেই সংঘটিত হয়েছিলো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মেরাজ। ইসলাম ধর্মে এমন কিছু পবিত্র স্থান রয়েছে যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং সম্মান রক্ষাকে মুসলমানরা তাদের ঈমানি দায়িত্ব মনে করে। মসজিদুল আকসা সেগুলোর একটি। পবিত্র মক্কা ও মদিনার পর মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান।
পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত। পৃথিবীর ১৮০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন পবিত্র আল–আকসা। রাসুলুল্লাহ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে প্রথমে মসজিদুল আকসা তথা বাইতুল মুকাদ্দাস সফর করেন যাকে বলা হয় ইসরা। (সুরা–১৭ ইসরা, আয়াত : ১)। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মিরাজ গমনের আগে এই মসজিদে সব নবী–রাসুলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন যে কারণে তাঁকে ‘ইমামুল আম্বিয়া’ বা নবীদের ইমাম ও ‘সাইয়েদুল মুরসালিন’ বা ‘রাসুলদের সরদার’ বলা হয়। এখানে বহু নবী–রাসুলের পুণ্যময় স্মৃতি রয়েছে এর আশপাশে অনেক নবী–রাসুলের সমাধি রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণস্থল ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। ফিলিস্তিন এমন পবিত্র ভূমি যেখানে অসংখ্য নবী–রাসুল পাঠিয়েছেন আল্লাহতাআলা। মহানবী (সা.)-এর শ্রেষ্ঠ মোজেজা মিরাজের রাতে তিনি মসজিদুল আকসায় অলৌকিকভাবে সব নবী–রাসুলকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআনে পবিত্র ভূমি বলে ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও এর আশপাশের অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে যাকে একসময় শাম বলা হতো। এখানে মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের কথা তুলে ধরা হলো :-
মসজিদুল আকসার মর্যাদা : মসজিদুল আকসা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। হাদিসে মহানবী (সা.)-এই মসজিদকে পৃথিবীর ইতিহাসের দ্বিতীয় মসজিদ আখ্যা দিয়েছেন। হজরত আবু জর গিফারির এক বর্ণনায় এসেছে আমি জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর রাসুল পৃথিবীতে প্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বললেন মসজিদুল হারাম। ফের তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম এরপর কোনটি? বললেন এরপর মসজিদুল আকসা। এরপর জানতে চাইলাম উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? বললেন চল্লিশ বছরের। মসজিদুল আকসায় ইবাদত করার অনেক সওয়াব রয়েছে। ইসলামে কেবল তিনটি মসজিদে ইবাদতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের অনুমতি রয়েছে। তৃতীয়টি মসজিদুল আকসা। হাদিসে এসেছে মহানবী (সা.)-বলেন তোমরা তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো মসজিদে বিশেষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে সফর করো না। মসজিদ তিনটি হলো–মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি ও মসজিদুল আকসা। মসজিদুল আকসায় নামাজ আদায় করার সওয়াব প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-বলেছেন যে ব্যক্তি মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদুল হারামে হজ–ওমরাহ পালনে যাবে তার আগের–পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে বা তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে যাবে। এখানে নামাজ আদায়েও রয়েছে বিশেষ ফজিলত। হাদিস শরিফে এসেছে নবী কারিম (সা.)-বলেন মসজিদে হারামের এক নামাজ এক লাখ নামাজের সমান আমার মসজিদের (মসজিদে নববি) এক নামাজ এক হাজার নামাজের সমান ও মসজিদুল আকসায় এক নামাজ পাঁচশ নামাজের সমান।
মসজিদুল আকসায় মহানবী (সা.): মিরাজের রাতে মহান আল্লাহ বিশেষ বাহন বোরাকে করে নবীজিকে প্রথমে মক্কা থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান। পবিত্র কোরআনে সেই বিরল সুযোগপ্রাপ্তির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহতাআলা বলেন পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা যিনি নিজ বান্দাকে রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন যার চারদিকে আমি বরকত দান করেছি যাতে আমি তাকে আমার শক্তির কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। মসজিদুল আকসায় মহানবী (সা.) সব নবী–রাসুলের সামনে নামাজের ইমামতি করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি বলেছেন এরপর আমি মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম। পরিশেষে সেখান থেকে আমাকে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা যিনি নিজ বান্দাকে রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন যার চারদিকে আমি বরকত দান করেছি। (সুরা ইসরা : ১)
ইসলামের প্রথম কিবলা: আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) মক্কায় থাকাকালে কাবাঘরকে সামনে রেখে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতেন। মদিনায় হিজরতের পর ১৬ মাস পর্যন্ত মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করেছেন। তাই বায়তুল মোকাদ্দাসকে ইসলামের প্রথম কিবলা বলা হয়। পরে মহানবী (সা.)এর ইচ্ছায় আল্লাহতাআলা মুসলমানদের কিবলা পবিত্র কাবাঘরের দিকে ফিরিয়ে দেন। পবিত্র কোরআনে সেই ঘটনার উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন নিশ্চয়ই আমি তোমাকে বারবার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব অবশ্যই আমি তোমাকে সেই কিবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে তুমি পছন্দ করো। এখন তুমি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করো এবং তোমরা যেখানেই থাকো সেদিকেই মুখ করো। (সুরা বাকারা : ১৪৪)
পুণ্যভূমি ফিলিস্তিন: যে ভূমিতে বসবাস করেছেন অনেক নবী–রাসুল। জন্মেছেন অনেক পুণ্যাত্মা। যে মাটির বুকে শুয়ে আছেন হজরত ইবরাহিম (আ.), হজরত ইসহাক (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত ইউসুফ (আ.), হজরত মুসা (আ.), হজরত দাউদ (আ.) ও হজরত সোলায়মান (আ.)-সহ অনেক পুণ্যবান পুরুষ। যে ভূমিতে কদম পড়েছে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সব নবী–রাসুলের। যেখানে আছে বহু প্রাচীন এলাহি নিদর্শন ও ইসলামি স্থাপনা। তাই ইসলামে এ ভূমির রয়েছে যথেষ্ট মর্যাদা। মুসলিমদের কাছে আছে অনেক কদর।
পবিত্র ও বরকতময় ভূমি ফিলিস্তিন: পবিত্র কোরআনে কেবল মসজিদুল আকসার আলোচনাই আসেনি ফিলিস্তিনের আলোচনাও এসেছে। তবে ফিলিস্তিন শব্দ কোরআনে নেই। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহতাআলা এই ভূমিকে বরকতময় ও পবিত্র বলেছেন। মুসা (আ.) এর যুগে বনি ইসরাইলকে ফিলিস্তিনে প্রবেশের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। মুসা (আ.) তাদের বলেছিলেন হে আমার সম্প্রদায় পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (সুরা মায়িদা : ২১)
মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস: সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। আর ইহুদিদের কাছে এটি খ্যাত টেম্পল মাউন্ট নামে। তারাও এটিকে তাদের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। মুসলমানদের এ পবিত্র ভূমি এখন ইহুদিদের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। মানবতার শত্রু ইহুদি জাতি আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত। হজরত মুসা (আ.)-এর সময় তাদের জন্য প্রদত্ত কুদরতি খাবারে অকৃতজ্ঞ হওয়ায় অভিশপ্ত হয়। মসজিদে আকসা কেবলই মুসলমানদের। এতে ইসরায়েলের কোনো অধিকার নেই। তাদের অধিকার না থাকায়ও তারা ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসায় আগ্রাসন চালাচ্ছে। সুতরাং আল আকসা ও জেরুজালেম সব আইনের ভিত্তিতেই শুধু মুসলমানদের। এতে ইহুদিদের কোনো অধিকার নেই। ১৮০ কোটি মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নিলে ইহুদিরা এর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হবে। যেহেতু এখানে মানবতা ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। তাই মানবতাবোধের জায়গা থেকে অমুসলিমদেরও উচিত ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। সুতরাং–প্রতিটি মুমিন–মুসলিমের কর্তব্য ফিলিস্তিন ও এর অধিবাসীদের প্রতি ভালোবাসা রাখা। বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসার পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে যেকোনো উপায়ে তাদের সাহায্য করা। তাও সম্ভব না হলে অন্তরে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা ও সেখানকার মুসলিমদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। এটাই ঈমানের দাবি। ফিলিস্তিন কেবল একটি দেশ নয়। আল–আক্বসা কেবল একটি মসজিদ নয়। আমাদের শেকড়। আমাদের আশ্রয়। ফিলিস্তিন–আল আক্বসার ভাগ্য এবং মুসলিম জাতির মুক্তি অভিন্ন সুতোয় গাঁথা। এসব কারণে ফিলিস্তিনকে ভালোবাসা তাদের পাশে থাকা ঈমানের দাবি। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে রজব মাসের ২৭ (২৬ দিবাগত) তারিখ বরকতময় এ রাতে পবিত্র লাইলাতুল মেরাজের শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত নৈতিক চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। পরকালের সফলতা দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট