পবিত্র জশ্‌নে জুলুসে ঈদ এ মিলাদুন্নবী (দ.) : মুসলিম জাতির আনন্দের দিন

সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছালেহ্‌ | শনিবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোমিনেরই ঈদ’। ১২ রবিউল আওয়াল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা এ পৃথিবীতে শুভাগমন করেন। এ মিলাদুন্নবী তারিখে অধিকাংশ মুসলমান খুশি উদযাপন করেন তথা ঈদএ মিলাদুন্নবী পালন করেন। প্রথম তিন যুগে বর্তমানের ন্যায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে ঈদ এ মিলাদুন্নবী পালিত না হলেও পরবর্তীতে চার মাযহাবের সর্বজন স্বীকৃত উলামায়ে কেরাম ঈদএ মিলাদুন্নবী পালন করেছেন এবং কেউ কেউ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যের উপর কিতাবও রচনা করেছেন। শত শত বছর ধরে পবিত্র মক্কা মদীনাসহ পৃথিবীর সকল ইসলামী রাষ্ট্রে ব্যাপক আকারে ঈদএ মিলাদুন্নবী পালিত হয়েছে।

মহান আল্লাহর অপার রহমত ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় মানবতার মুক্তির দূত রহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয়নবী (.) এর পৃথিবীতে শুভাগমনের আনন্দকেই ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (.), বলা হয়। যার নূরের আলোয় সারা পৃথিবীতে শুভাগমনের আনন্দকেই ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (.)’ বলা হয়। যার নূরের আলোয় সারা পৃথিবী আলোকিত হয়েছিল। তার ওপরই নাজিল হয়েছে আসমানি গ্রন্থ আলকোরআন।

জশনে শব্দের অর্থ খুশি উদ্‌যাপন করা, আনন্দ প্রকাশ করা আর জুলুছ শব্দের অর্থ বিশেষ কোনো উপলক্ষকে সামনে রেখে অনেক লোক জমায়েত হয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করা (ফিরুজুল লুগাত)। সুতরাং জশনে জুলুছ এর অর্থ হলো গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়কে উপলক্ষ করে রাজপথে আনন্দ মিছিল করা, যা হবে নেয়ামতের শোকর (কৃতজ্ঞতা) আদায়ের বহিঃপ্রকাশ।

বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের কাছে জশনে জুলুছ আর অপরিচিত কোন বিষয় নয়। বিশ্বনবী রাহমাতুলল্লিল আলামীন হুজুর মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিশাল রহমত এর ভাণ্ডার নিয়ে পৃথিবীর বুকে শুভাগমন করেছিলেন সে নেয়ামত কেবল মানবজাতির জন্য নেয়ামত এমনটি নয়, বরং তা ছিল সমগ্র বিশ্বভ্রমাণ্ডের আঠার হাজার মাখলুকাতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই এই মহান দিবসকে উপলক্ষ করে প্রতি বৎসর ঐ দিনে নেয়ামতের শোকরিয়া প্রকাশের নিমিত্তে মিলাদ মাহফিল করা জিকির আজকার করা আনন্দ উদযাপন করা জশনে জুলুছ করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয় বরং বড় ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের কাজ।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত (জন্ম) মানব জাতির মুক্তির বড় উপলক্ষ। তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে দুনিয়াতে এসেছিলেন। তাই তাঁর আবির্ভাব মানব জাতির জন্য আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ ও নেয়ামত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ অনুগ্রহ বা নেয়ামত প্রাপ্তির পর খুশী ও আনন্দ উদযাপনের জন্য মানুষের প্রতি আল্লাহর তাগাদা রয়েছে। এ খুশী বা আনন্দ বিশেষ গোষ্ঠী দল বা দেশের জন্য সীমাবদ্ধ নয় এ খুশী সমগ্র মানব জাতির জন্য।

যেহেতু আল্লাহ ঘোষণা করেছেন

আল্লাহতায়ালা প্রিয় নবী (.) কে দু’জাহানের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন, আল্লাহর নবীকে দুনিয়ায় প্রেরণ মানুষের প্রতি স্রষ্টার বড় করুণার নিদর্শন। যারা এতবড় অনুগ্রহ প্রাপ্তির পরও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে না তারা কেয়ামত পর্যন্ত অকৃতজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি বহন করবে।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ থেকে চৌদ্দ’শ বৎসর আগে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে একত্ববাদের কথা বলে মানুষের মধ্যে অবাঞ্চিত বিশ্বাসের যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেনআজো এ একত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ দেবার ক্ষমতা কারো নেই। অথচ আজো অনেক মানুষ ইচ্ছা অনিচ্ছায় বহু দেবদেবীর পূজা আর্চনায় লিপ্ত রয়েছে। তারা নিজেরাও জানে না যে এ দেব দেবীর পক্ষে তাদের সকল জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এমন কি তাদের একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া পুজিত দেবদেবীর নড়াচড়া করবারও কোন ক্ষমতা নেই। এর পরও তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের প্রথা আঁকড়ে ধরে আছে। অথচ আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (.) অস্থায়ী এ নশ্বর জগতের পরে অন্তকালীন পরকালীন মুক্তির জন্য মানুষকে অকাট্য দলিলসহ একত্ববাদের কথা বলছেন।

যারা সেদিন আল্লাহর নবীর কথাকে আস্থায় এনে সকল যুক্তি তর্কের উর্ধে উঠে একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়েছেন তারা আল্লাহর পরম অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়েছেন এবং বিশ্বাসীদের জন্য কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর রহমতের দরজা খোলা থাকবে।

হযরত মুহাম্মদ (.) দুনিয়াতে আবির্ভাবের পর তাঁর দাওয়াতের বিশেষত্ব হচ্ছেতিনি গোত্র বর্ণ, বংশ, ভাষা ও অঞ্চলের সীমাবদদ্ধ সকল ব্যবধানকে উপেক্ষা করে মানুষকে মানুষ হিসেবেই আহবান করেছেন। তিনি এমন কিছু মূলনীতি পেশ করেন যা স্থানকাল পাত্রের উর্ধে সকল মানুষের জন্যই কল্যাণকর। বর্ণের উৎপীড়ন, বংশের বড়াই, জাতপাতের সকল প্রশ্নের কবর রচনা করে মানুষ হিসেবে মানুষের মানবিক সম্পর্ককে উর্ধে তুলে ধরে প্রিয় নবী (.) মানবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেন। অথচ বর্তমান সভ্য জগতেও মানুষ আজ চরম বর্ণবাদের শিকার। এখনো হিন্দু ধর্মে জাতপাতের যে ব্যবধান রয়েছে তার মুলোৎপাটন করা বর্তমান বিশ্ব শক্তির পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ সেসব ধর্মই এ বিভক্তি রচনা করে দিয়েছেন।

আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আমি মানুষকে সর্বোত্তম ভাবে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাকে নিম্নতম পর্যায়ে ফেলে দিয়েছি।’ এভাবেই প্রিয় নবী (.) মানুষের জন্য চিরস্থায়ী চারিত্রিক গুণ সম্পন্ন বিধানই কেবল নিয়ে আসেননিবরং মানুষের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র এবং আচার আচরণের কালজয়ী ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন।

প্রিয় নবী (.) দুনিয়াতে আসার পর যাদেরকে নানানভাবে গুণান্বিত করে উৎকৃষ্ট মানুষে পরিণত করেছেন। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীতে ঐ সমস্ত মানুষকে বন্দী করে মানবতাকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল।

সে বন্দীদশা থেকে মানবতাকে মুক্ত করে দুনিয়াকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলেছিলেন প্রিয় নবী (.)। বর্তমান কম্পিউটার যুগে আধুনিক বিশ্বের চালচিত্র দেখে একথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে আমরা পুনরায় ‘আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগে ফিরে যাচ্ছি’।

কেউ লাইসেন্স নিয়ে মাস্তানী করছে, আর কেউ বিনা লাইসেন্সে সন্ত্রাসী করছে। কেউ লাইসেন্স নিয়ে দুর্নীতি করছে, কেউ বিনা লাইসেন্সে আইন বিরুদ্ধ কাজ করছে। এ হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব সমাজের করুণ চিত্র। নীতি হচ্ছে সমাজের ব্লাড বা রক্ত। রক্ত ছাড়া যেমন মানুষ চলতে পারে না, তেমনি নীতি ছাড়া সমাজ চলতে পারে না। আল্লাহর প্রিয় হাবীব (.) যে নীতি প্রতিষ্ঠা করে সমাজে স্পন্দন সৃষ্টি করেছিলেন। সে নীতি আজ মানুষের স্পর্শ থেকে সমান্তরাল দূরে অবস্থান করছে। যার ফলে সমাজ হয়েছে কক্ষচ্যুত। ধীরে ধীরে সমাজের সকল সামাজিক বন্ধনই শিথিল হয়ে গেছে। আজ মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে, সমাজ সমাজের বিরুদ্ধে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আজ নতুন করে চৌদ্দশত বছরের পূর্বে রাসুলুল্লাহ (.) এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সর্বোতভাবে। যা এ যাবৎকালের সকল পরীক্ষায় কালোত্তীর্ণতার প্রমাণ দিয়েছে। মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের যুগে মানবতাকে দংশন করে চলেছে। অথচ এখনো বাঁচার যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। বরং কারা কত দ্রুত কত বেশি মানুুষ হত্যা করে প্রদর্শনী দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বব্যাপী। সোভিয়াত বিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারত হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার করে পরে তার ব্যবহারে ব্যাপক গণহত্যা দেখে জীবনের শেষ প্রান্তে তার আত্ম জীবনীতে প্রায়শ্চিত্তের কথা বলেছেন।

সমাজ বিপ্লবের যে মন্ত্র প্রিয় নবী (.) আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ বছর পূর্বে মানুষকে শিখিয়ে গেছেন, সে মন্ত্র আজ নতুন করে রপ্ত করতে হবে।

এরই প্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে শান্তি ও কল্যাণ ফিরে আসবে, সমৃদ্ধির পথ সুগম হবে। আল্লাহ পাক সবাইকে তার প্রিয় হাবীব (.) এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে তার কল্যাণ লাভের যোগ্যতা দান করুক, এবং উভয় জগতের সাফল্য লাভের সুযোগ দান করুক আমিনবেহুরমতি সাইয়িদিল মুরসালিন, আমিন, ছুম্মা আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিম মাদ্‌রাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপনের তাৎপর্য
পরবর্তী নিবন্ধমহানবীর (দ.) দুনিয়ায় শুভাগমন : আল্লাহপাকের সেরা অনুগ্রহ