পবিত্র কোরআন নাজিল ও তাকওয়া অর্জনের মাস রমজান

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ২২ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

রমজান মাসের শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত হল কোরআন অবতীর্ণ হওয়া। রমজান মাসের সম্মান এই কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণেই। রমজান মাসে লাওহে মাহফুজ থেকে পূর্ণ কোরআন একসাথে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয়।

তাকওয়া অর্জনের মাস রমজান। আর সিয়াম সাধনা বা রোজা পালন তাকওয়া অর্জনের অনন্য সোপান। রমজানে মাসব্যাপী রোজা পালন ফরজ করার তাৎপর্য এখানেই নিহিত। আল্লাহতাআলা বলেন হে মুমিনগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য ফরজ করা হয়েছিল ; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সুরা বাকারাআয়াত : ১৮৩)। রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতএ তিনের সমন্বয়ে পবিত্র মাহে রমজান। মাহে রমজান ও তাকওয়ার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কেননা রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদারকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়। তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের রোজা পালন ফরজ করা হয়েছে। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহতাআলা বলেছেন হে মুমিনগণ! তোমরা তাকওয়া অর্জন করো আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও। ইসলামী আখলাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাকওয়া। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি মুমিন জীবনের ভূষণ। মানব জীবনে তাকওয়া এমন একটি মহৎগুণ যা মানবকে যাবতীয় কুকর্ম হতে রক্ষা করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করে। তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে রমজান মাসে সিয়াম সাধনায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সহজ হয়। আল্লাহতায়ালা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলো বর্জন করা এবং যা কিছু ফরজ করেছেন সেগুলো পালন করার নামই তাকওয়া। ইবাদতবন্দেগির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা। আল্লাহতায়ালা সুরা হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন আল্লাহর কাছে এসবের (কোরবানির পশু) রক্তগোশত পৌঁছে না বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।

পবিত্র রমজানের পাঁচটি সুন্নত ১. সাহরি খাওয়া ২. ইফতার করা ৩. তারাবির নামাজ পড়া ৪. কোরআনমজিদ তিলাওয়াত করা ৫. ইতিকাফ করা। এই পাঁচটি সুন্নতের দুটিই হলো প্রাকৃতিক প্রয়োজন ; যা মানুষ বাধ্য হয়ে করে থাকে। রোজা রাখার শক্তিুসামর্থ্য অর্জনের জন্য সাহরি খাওয়া এবং রোজার ক্লান্তি ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য ইফতার করা। মূলত শেষোক্ত তিনটিই হলো রমজানের মূল ইবাদত বা মৌলিক উদ্দেশ্য। আর এই তিনটির সঙ্গেই রয়েছে কোরআনের একান্ত সম্পর্ক। যথা : রমজানের তৃতীয় সুন্নত তারাবির নামাজ এতে কোরআন তিলাওয়াত করা হয় যা নামাজের ফরজ ও ওয়াজিব রকন এবং খতম তারাবিতে পূর্ণ কোরআন মজিদ খতম করা হয় যা সুন্নত। রমজানের চতুর্থ সুন্নত কোরআন তিলাওয়াত। সাহাবায়ে কিরাম প্রায় সারা বছর প্রতি মাসের প্রতি সপ্তাহে পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার তিলাওয়াত করতেন। প্রতি সাত দিনে এক খতম পড়তেন বলেই কোরআন মজিদ সাত মঞ্জিলে বিভক্ত হয়েছে। তাঁরা রমজান মাসে আরও বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। রমজানের সঙ্গে কোরআনের সম্পর্কও সুগভীর। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছেশাহ্‌র রমাদ্বান আল্লাজি উনজিলা ফিহিল কোরআন। রমজান মাস যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। মানব জাতির হেদায়তের জন্য এ গ্রন্থখানা সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। (সুরা: বাকারা, আয়াত : ১৮৫)। পবিত্র কোরআন এ আরবি বারো মাসের মধ্যে একমাত্র রমজান মাসের নাম উল্লেখ আছে। সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আলকুরআন অবতীর্ণের কারণেও এ মাস শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।

সম্মানিত শবে কদর ও মহিমান্বিত পবিত্র কোরআন : ইসলামে স্বীকৃত বরকতময় ও মহিমান্বিত যেসব দিবস রজনী রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর। কদরের এক অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। অন্যান্য রাতের তুলনায় এ রাত মহিমান্বিত হওয়ার কারণে এটাকে লাইলাতুল কদর তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। আবু বকর ওয়াররাক (রহ.) বলেন কদর রাতকে লাইলাতুল কদর বলার কারণ হচ্ছে এ রাতে আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন সেটা মহিমান্বিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব এবং যে নবীর ওপর অবতীর্ণ তিনিও মহিমান্বিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আর যে উম্মতের জন্য অবতীর্ণ করেছেন তারা মহিমান্বিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। সর্বোপরি আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার সম্মান ও মূল্য মহিমান্বিত থাকে না সেও এ রাতে তওবা ইস্তিগফার ও ইবাদতুবন্দেগির মাধ্যমে মহিমান্বিত হয়ে যায়। আল্লাহতাআলা বলেন নিশ্চয়ই আমি কদরের রজনীতে কোরআন নাজিল করেছি। কেয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য পবিত্র কোরআন সুপারিশ করবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে নবীজি (সা.) এরশাদ করেন রোজা ও কোরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। অন্য সময়ের তুলনায় রমজান মাসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের সওয়াব বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ রমজান মাসের নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ সমতুল্য। আর ফরজ ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরজ সমতুল্য।

তাকওয়া অর্জনের মাস রমজান। তাকওয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলতে থাক (তাকওয়া অবলম্বন কর) তাহলে তিনি তোমাদের ভালমন্দের মধ্যে পার্থক্য করার মানদন্ড বা যোগ্যতা ও শক্তি দান করবেন তোমাদের ভুলত্রুটি ও গুণাহরাশি ক্ষমা করবেন। কেন না আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল। তাকওয়া অবলম্বন করার সুফল ও পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ বলেন যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দাঁড়াবার ভয় করে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখে তার স্থান হবে জান্নাত। ইসলামী জীবনদর্শনে তাকওয়াই সকল সৎগুণের মূল। তাকওয়া একটি মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের ব্যক্তি ও সামাজিক চরিত্র গঠনে তাকওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি চরিত্র গঠনে তাকওয়া একটি সুদৃঢ় দুগর্ স্বরূপ। যার মধ্যে তাকওয়া বিদ্যমান সে সর্বদা আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করে। আর যে আল্লাহকে হাজিরনাজির মনে করে সে কোন পাপ কাজে জড়াতে পারে না। অপর পক্ষে যে তাকওয়া শূন্য তার দ্বারা সকল অপকর্ম করাই সম্ভব। সুতরাং তাকওয়া সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ ও সৎ জীবনযাপনের মূল কথা। মাহে রমজানে সিয়ামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাকওয়া হচ্ছে হৃদয়ের এক বিশেষ অবস্থার নাম। তাকওয়া হলো আল্লাহর বিধিবিধান পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে না পারলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা অসম্ভব। সিয়ামের সঙ্গে রয়েছে তাকওয়ার নিবিড় যোগসূত্র। সিয়াম মানুষের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টি করে। ফলে পরিবার ও সমাজজীবনে মানুষ যাবতীয় অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে এবং সৎ কাজ করার জন্য অগ্রসর হতে পারে। তাকওয়া মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইহকালীন জীবনে শান্তি ও পরকালীন জীবনে মুক্তির মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন। তাকওয়ার মাধ্যমেই বান্দা ইহকাল ও পরকালে তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। তাকওয়ার গুণাবলি অর্জিত হওয়ার পর রোজাদার মুমিনের হৃদয় আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। এমনিভাবে রমজান মাসে তাকওয়া ভিত্তিক চরিত্র গঠনে রোজাদার ব্যক্তি আন্তরিক ও নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।

আল্লাহপাক এর মহান বাণী পবিত্র আল কুরআনসহ আসমানী কিতাবসমূহ এই মাসে নাজিল হয়েছে। এই মাসেই রয়েছে পবিত্র লাইলাতুল কদর। যার মূল্য হাজার মাস ইবাদতের ঊর্ধ্বে। এই মাসের প্রথম দশ দিন রহমতের বারিধারায় অবগাহন দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাত ও ক্ষমার আলোকে উদ্ভাসিত আর শেষ দশ দিন জাহান্নাম হতে মুক্তি ও নিষ্কৃতির সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ লাভ করে ধন্য হওয়ার কামনা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের অন্তরে থাকা প্রয়োজন। পবিত্র রমজান মাস মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রিয় বান্দার প্রেম বিনিময়ের সবচেয়ে উত্তম সময়। এই মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসের ফজিলত ও মর্যাদা বেড়ে গেছে আরও বহুগুণ এই মাসে তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাজত করুক। সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার দৃঢ়তা দান করুক। আমাদের ঈমানকে মজবুত করার সুযোগ দিক। পবিত্র রমজানের ফজিলত জেনে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুক। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপঞ্চকবির গীতিধারা
পরবর্তী নিবন্ধছোট ছেলে বীরের জন্মদিনে শাকিবের শুভেচ্ছা